শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় বাজারগুলোতে (Winter Market) যেন আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। নভেম্বরের শেষ থেকেই রাজ্যের ছোট-বড় বাজারে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে, আর ডিসেম্বর ঢুকতেই সেই ভিড় এক লাফে দ্বিগুণ হয়েছে। ফল, সবজি, পোশাক, মিষ্টি, গৃহস্থালির পণ্য, হস্তশিল্প, খেলনা—সব ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা বলছেন, “এ বছর শীতের মরসুমে ব্যবসা অনেক ভালো। গত দুই–তিন বছরের তুলনায় পরিষ্কার ভাবে বিক্রি বেড়েছে।”
শীতকালকে রাজ্যের বণিকমহল ইতিমধ্যেই বলছেন, “Winter Business Boom Year”। বিশেষ করে কলকাতা-শিলিগুড়িসহ, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব-বর্ধমান, নদিয়া, মালদহ,জেলায় বাজারগুলো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত। দোকানদারদের দাবি, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ব্যবসা অন্তত ৩০–৫০ শতাংশ বেড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, কিছু সেগমেন্টে বিক্রি দ্বিগুণ পর্যন্ত হয়েছে।
শীতের ব্যবসা বাড়ার অন্যতম কারণ হল, উৎসব-পার্বণের ধারাবাহিকতা। দীপাবলি, ভাইফোঁটা, জগদ্ধাত্রী পূজা, গুরু নানক জয়ন্তী উৎসবের পরই শুরু হয়েছে খ্রিষ্টমাস ও বছরের শেষের প্রস্তুতি। বাংলার শীত এখন কেবল আবহাওয়া নয়, বরং কেনাকাটার মরসুমও। বড় শহর থেকে মফস্বল—সব জায়গার বাজারে এই চিত্র স্পষ্ট।
পোশাক দোকানগুলোতে শীতের জ্যাকেট, সোয়েটার, শাল, উলের ক্যাপ, গ্লাভস—এসবের চাহিদা শুরু থেকেই বেশি। নিউ মার্কেট, এসপ্ল্যানেড, গড়িয়া, বেহালা, দুর্গাপুর, আসানসোল, শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট—সব জায়গায় শীতের পোশাকে ‘গ্রাহক রাশ’। অনেক দোকানে সন্ধ্যা ৮টার পরে নতুন স্টক ভরতে হয়। উত্তরবঙ্গের বাজারগুলোতে উলের পোশাক বিক্রি আরও তুঙ্গে৷ শিলিগুড়ি, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির দোকানদাররা জানাচ্ছেন, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই শীতের চাপ বাড়ায় বিক্রি ৬০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
শীতের আরেকটি বড় ব্যবসা হল মিষ্টি ও বেকারি পণ্য। নলেন গুড় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মিষ্টির বাজারে নতুন জোয়ার। কলকাতা, কৃষ্ণনগর, বারাসত, বর্ধমান, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এলাকার মিষ্টির দোকানগুলোতে নলেন গুড়ের সন্দেশ, রসগোল্লা, পায়েস, দই, ছানা-পোড়ার চাহিদা আকাশছোঁয়া। অনেক দোকান দিনেই তিনবার করে গুড় সংগ্রহ করছে। বিক্রেতাদের দাবি, এ বছর নলেন গুড়ের মিষ্টিতে ব্যবসা ৩০% এর বেশি বাড়বে।
বাঙালির শীতে বাজারের প্রাণকেন্দ্র হল সবজি বাজার। ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলো, গাজর, বিট, টমেটো, পালং, ধনে পাতার মতো শীতের সবজিতে জেলায় জেলায় ভিড় লেগেই আছে। যদিও কিছু সবজির দাম ওঠানামা করছে, তবুও বিক্রি কমেনি। দক্ষিণবঙ্গের অনেক বাজারে সকাল ৭টার মধ্যেই তাজা সবজি শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, “এ বছর মানুষ আগের চেয়ে বেশি সবজি কিনছেন।”
শীতের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে খাদ্যপ্রস্তুত পণ্যের চাহিদা বাড়ারও। মোমো, স্যুপ, গ্রিল চিকেন, রোল—রাস্তায় রাস্তায় সন্ধ্যার পর ভিড় বেড়েছে। কলকাতা, হাওড়া, শিলিগুড়ি ও আসানসোলে স্ট্রিট-ফুড ব্যবসায়ের দৈনিক আয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অনেকে বলছেন, শীত তাদের ব্যবসার ‘গোল্ডেন টাইম’।
মেলায় ভিড়ও এই শীতকালীন ব্যবসা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। বইমেলা, শিল্পমেলা, হস্তশিল্প মেলা, ক্রিসমাস মার্কেট—সব মিলিয়ে শীতের সন্ধ্যাগুলো জমজমাট। বিশেষ করে শিলিগুড়ি মিলনমেলা, কলকাতার মিলনমেলা গ্রাউন্ড, হাওড়া মেলা—এসব জায়গায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড় হচ্ছে। হস্তশিল্প ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, রাজ্যের বাইরে থেকে ক্রেতারাও অনেক বেশি আসছেন।
রাজ্যের ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীতের ব্যবসায় বৃদ্ধির প্রধান কয়েকটি কারণ হল—
- আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়ায় মানুষ বাজারে বেশি বেরোচ্ছেন
- উৎসব মরসুম দীর্ঘ হওয়া
- পর্যটন শিল্পে উত্থান, ফলে হোটেল-রেস্তোরাঁয় চাহিদা বৃদ্ধি
- অনলাইন ও অফলাইনের যৌথ চাহিদা বাজারকে নতুন গতি দিচ্ছে
- স্থানীয় পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে
২০২৫ সালে Bengal Chamber of Commerce-এর এক রিপোর্ট বলছে—শীতকালীন বাজারে এই বছর রাজ্যের খুচরা ব্যবসায় বৃদ্ধি হবে কমপক্ষে ২৫%। যার বড় অংশই বাজারের ছোট দোকানদার, হকার, স্ট্রিট-ফুড বিক্রেতা ও হস্তশিল্পীদের হাতে যাবে।
ছোট ব্যবসায়ীদের মতে, শীতকালই বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী আয়ের সময়। একজন পোশাক বিক্রেতার কথায়—“বর্ষায় ব্যবসা কমে যায়, গরমেও মানুষ কম কেনাকাটা করে। শীত এলে বাজার জমে ওঠে। এই তিন মাসের আয় আমাদের পুরো বছরের সমান।”
ব্যবসার উত্থানে খুশি পরিবহন থেকে পাইকার সবাই। সকাল-বিকেল দেশের নানা শহর থেকে পণ্যবাহী গাড়ি আসছে কলকাতা, সিলিগুড়ি এবং বর্ধমানের পাইকারি বাজারে।
সব মিলিয়ে, ২০২৫ সালের শীত পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় ব্যবসার জন্য আশাব্যঞ্জক। মুদিখানা থেকে পোশাক, সবজি থেকে হস্তশিল্প—সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এক প্রবল “Winter Business Boom”, যা রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
