কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের জন্য ৮ম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হতে চলেছে, যা ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কমিশনটি প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন কাঠামোতে পরিবর্তন আনবে। তবে, কমিশনের আনুষ্ঠানিক গঠন এবং এর শর্তাবলী (টার্মস অফ রেফারেন্স) এখনও চূড়ান্ত হয়নি, যা কর্মচারীদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন এবং ইউনিয়ন ৮ম বেতন কমিশন বাস্তবায়নের আগে তাদের প্রধান দাবিগুলি উত্থাপন করেছে। নীচে এই শীর্ষ ৫টি দাবি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।
১. উচ্চ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি ৮ম বেতন কমিশনের জন্য ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ৩.০ থেকে ৩.৫-এর মধ্যে নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর হল বেতন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত একটি গুণক, যা বর্তমান বেসিক বেতনের উপর প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে, ৭ম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭, যা ন্যূনতম বেসিক বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে ১৮,০০০ টাকায় উন্নীত করেছিল। ইউনিয়নগুলির দাবি, ৩.০-৩.৫ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ন্যূনতম বেসিক বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে ৫১,৪৮০ টাকা বা তার বেশি বাড়িয়ে দেবে। এই বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবেলায় সহায়ক হবে।

২. মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) বেসিক বেতনের সঙ্গে একীভূতকরণ
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের আরেকটি প্রধান দাবি হল মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) বেসিক বেতনের সঙ্গে একীভূত করা। বর্তমানে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিএ ৫৫% এ দাঁড়িয়েছে, এবং জুলাই ২০২৫ থেকে এটি ৫৮% হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কর্মচারী ইউনিয়নগুলি দাবি করছে যে ৫০% বা তার বেশি ডিএ বেসিক বেতনের সঙ্গে একীভূত করা হোক, যাতে মোট বেতন কাঠামো উন্নত হয়। যদিও ৫ম বেতন কমিশনের সময় এই প্রথা ছিল, তবে পরবর্তী কমিশনগুলিতে এটি বন্ধ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক রাজ্যসভায় সরকার জানিয়েছে যে বর্তমানে ডিএ একীভূত করার কোনো পরিকল্পনা নেই, তবে কর্মচারী সংগঠনগুলি এই দাবিতে অনড় রয়েছে।
৩. পেনশন সংস্কার
পেনশনভোগীদের জন্য ৮ম বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় জয়েন্ট কাউন্সিল অফ অ্যাকশন (এনসিজেসিএম) এবং অন্যান্য সংগঠন পেনশন কমিউটেশনের সময়কাল ১৫ বছর থেকে কমিয়ে ১২ বছর করার দাবি জানিয়েছে। এছাড়াও, তারা পেনশনের পরিমাণ ৩০% পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি করেছে, যাতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবেলা করতে পারেন। বর্তমানে ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা, যা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে ২৫,৭৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই দাবি পেনশনভোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে।
৪. বেতন স্তরের একীকরণ
কর্মচারী সংগঠনগুলি বিভিন্ন বেতন স্তরের একীকরণের দাবি জানিয়েছে, যাতে ক্যারিয়ারের উন্নতি সম্পর্কিত সমস্যাগুলি সমাধান করা যায়। বর্তমান বেতন ম্যাট্রিক্সে একাধিক স্তর রয়েছে, যা কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করে। জাতীয় কাউন্সিল অফ জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (জেসিএম) এর স্টাফ সাইড প্রস্তাব করেছে যে কিছু বেতন স্তর একীভূত করা হোক, যাতে বেতন কাঠামো সরলীকৃত হয় এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি পায়। এই দাবি কমিশনের শর্তাবলী চূড়ান্ত করার সময় বিবেচনাধীন রয়েছে।
৫. সিজিএইচএস এবং অন্যান্য ভাতার সংস্কার
কেন্দ্রীয় সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্প (সিজিএইচএস) এবং অন্যান্য ভাতা, যেমন হাউস রেন্ট অ্যালাওয়ান্স (এইচআরএ) এবং ট্রান্সপোর্ট অ্যালাওয়ান্স (টিএ), সংস্কারের দাবি উঠেছে। গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ন্যাশনাল কনফেডারেশন (জিইএনসি) সিজিএইচএস সুবিধাগুলির যৌক্তিকীকরণ এবং ইউনিফর্ম পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস) নিয়মের স্পষ্টতার দাবি জানিয়েছে। এছাড়াও, কর্মচারীরা চান যে এইচআরএ এবং টিএ মুদ্রাস্ফীতি এবং শহরের শ্রেণিবিভাগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়ানো হোক। উদাহরণস্বরূপ, মেট্রো শহরে এইচআরএ বর্তমানে ২৭%, যা আরও বাড়ানোর দাবি উঠেছে।
বাংলার প্রেক্ষাপটে তাৎপর্য
পশ্চিমবঙ্গে হাজার হাজার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগী রয়েছেন, যারা এই দাবিগুলির বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করছেন। কলকাতার মতো মেট্রো শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উচ্চ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং ডিএ একীভূতকরণের দাবি এখানকার কর্মচারীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, সিজিএইচএস সুবিধার উন্নতি স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।
৮ম বেতন কমিশনের বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, কমিশনের শর্তাবলী এবং সুপারিশ চূড়ান্ত করতে বিলম্ব হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। উচ্চ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ডিএ একীভূতকরণ, পেনশন সংস্কার, বেতন স্তরের একীকরণ এবং ভাতা সংস্কারের দাবিগুলি কমিশনের সুপারিশে প্রতিফলিত হলে এটি কর্মচারীদের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। বাংলার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা এই দাবিগুলির বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছেন।