এই দম্পতি ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন— এটি কি সত্যিই মূল্যবান ছিল?

Personal Loan to Travel: বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন অনেকেরই মনে থাকে, কিন্তু এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সাহস, পরিকল্পনা এবং অর্থ। কলকাতার এক তরুণ…

Personal Loan to Travel

Personal Loan to Travel: বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন অনেকেরই মনে থাকে, কিন্তু এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সাহস, পরিকল্পনা এবং অর্থ। কলকাতার এক তরুণ দম্পতি (কাল্পনিক), অভিষেক চৌধুরী (৩২) এবং প্রিয়াঙ্কা দাস (৩০), তাদের বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যক্তিগত ঋণ নিয়েছিলেন। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত কেবল তাঁদের জীবনই পাল্টে দেয়নি, বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ তাঁদের এই সাহসিকতাকে প্রশংসা করছেন, আবার কেউ এটিকে আর্থিক দায়িত্বহীনতা বলে সমালোচনা করছেন। তাঁদের এই যাত্রা কি সত্যিই মূল্যবান ছিল? চলুন জেনে নিই তাঁদের গল্প।

যাত্রার শুরু: স্বপ্নের পথে একটি ঝুঁকি
অভিষেক একটি আইটি কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রিয়াঙ্কা একজন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার। ২০২৩ সালে বিয়ের পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের জীবনের একটি বছর বিশ্ব ভ্রমণে কাটাবেন। কিন্তু তাঁদের সঞ্চয় মাত্র ৫ লক্ষ টাকা ছিল, যা বিশ্ব ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তাঁরা একটি ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অভিষেক বলেন, “আমরা দুজনেই স্বপ্ন দেখতাম বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি, প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গে মিশতে। আমরা ভেবেছিলাম, জীবন একটাই, এই সুযোগ হয়তো আর আসবে না। তাই আমরা ১৫ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত ঋণ নিয়েছিলাম।”

   

তাঁরা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে তাঁদের যাত্রা শুরু করেন। এক বছরে তাঁরা ১৮টি দেশ ভ্রমণ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ইতালি, জাপান, পেরু, থাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। তাঁরা রোমের কলোসিয়াম থেকে মাচু পিচু, টোকিওর ব্যস্ত রাস্তা থেকে সাফারিতে বন্যপ্রাণী দেখেছেন। তাঁদের ভ্রমণের ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।

আর্থিক ঝুঁকি ও বিতর্ক
১৫ লক্ষ টাকার ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না। প্রিয়াঙ্কা বলেন, “আমরা জানতাম এটি একটি বড় ঝুঁকি। আমাদের মাসিক কিস্তি ৩৫,০০০ টাকা, এবং আমাদের সঞ্চয়ও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, এই অভিজ্ঞতার মূল্য টাকায় মাপা যায় না।” তাঁরা ভ্রমণের সময় খরচ কমানোর জন্য বাজেট-ফ্রেন্ডলি হোস্টেলে থাকতেন, স্থানীয় খাবার খেতেন এবং কম খরচের ফ্লাইট বেছে নিতেন। তবুও, তাঁদের মোট খরচ ১৮ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ তাঁদের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন। একজন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী লিখেছেন, “এই দম্পতি আমাদের দেখিয়েছে যে স্বপ্ন পূরণের জন্য সাহস লাগে। তাঁরা আমাদের প্রেরণা!” অপরদিকে, অনেকে এটিকে আর্থিক দায়িত্বহীনতা বলে সমালোচনা করেছেন। একজন এক্স ব্যবহারকারী লিখেছেন, “১৫ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়ে ভ্রমণ? এটি কি সত্যিই বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত? এই টাকা দিয়ে বাড়ি বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা যেত!”

এটি কি মূল্যবান ছিল?
অভিষেক এবং প্রিয়াঙ্কার মতে, তাঁদের এই ভ্রমণ জীবনের একটি অমূল্য অভিজ্ঞতা। অভিষেক বলেন, “আমরা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি, মানুষ এবং জীবনযাত্রা দেখেছি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। আমরা এখন আরও সহনশীল এবং ধৈর্যশীল হয়েছি।” প্রিয়াঙ্কা যোগ করেন, “আমরা জাপানে সুমো কুস্তি দেখেছি, পেরুতে ইনকা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ ঘুরেছি, এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় সাফারিতে জিরাফের সঙ্গে হেঁটেছি। এই মুহূর্তগুলো আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।”

Advertisements

তবে, তাঁরা স্বীকার করেন যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অভিষেকের স্থিতিশীল চাকরি এবং প্রিয়াঙ্কার ফ্রিল্যান্স কাজের মাধ্যমে তাঁরা মাসিক কিস্তি পরিশোধ করছেন। তাঁরা বলেন, “আমরা বিলাসিতার জন্য ঋণ নিইনি। আমরা এমন একটি অভিজ্ঞতার জন্য ঋণ নিয়েছি যা আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। আমরা কোনও আক্ষেপ করি না।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত
আর্থিক পরামর্শদাতা রোহিত শাহ বলেন, “ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে। তবে, এটি একটি উচ্চ-সুদের ঋণ, যার সুদের হার ১০-১৫%। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আর্থিক পরিকল্পনা জরুরি।” তিনি পরামর্শ দেন, ভ্রমণের জন্য সঞ্চয় করা বা কম খরচের গন্তব্য বেছে নেওয়া বুদ্ধিমান হতে পারে। অপরদিকে, মনোবিজ্ঞানী ড. সুপ্রিয়া সেন বলেন, “এই ধরনের অভিজ্ঞতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে, এটি করতে গিয়ে আর্থিক চাপ সৃষ্টি হলে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা হতে পারে।”

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব
অভিষেক এবং প্রিয়াঙ্কা তাঁদের ভ্রমণের গল্প ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করে একটি বড় ফলোয়ার বেস তৈরি করেছেন। তাঁদের অ্যাকাউন্টে এখন ৫০,০০০-এর বেশি ফলোয়ার রয়েছে। তাঁরা ভ্রমণের টিপস, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং বাজেট ভ্রমণের পরামর্শ শেয়ার করেন। এই জনপ্রিয়তা তাঁদের কিছু স্পনসরশিপ এনে দিয়েছে, যা তাঁদের ঋণ পরিশোধে সাহায্য করছে। প্রিয়াঙ্কা বলেন, “আমাদের ভ্রমণের গল্প অনেককে প্রেরণা দিয়েছে। আমরা এখন তরুণদের বাজেটে ভ্রমণের পরামর্শ দিই।”

এটি কি সবার জন্য?
অভিষেক এবং প্রিয়াঙ্কার গল্প অনেককে স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করলেও, এটি সবার জন্য বাস্তবসম্মত নয়। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ নিয়ে ভ্রমণের আগে জরুরি তহবিল, স্বাস্থ্য বীমা এবং ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা থাকা জরুরি। তবে, এই দম্পতির গল্প প্রমাণ করে যে সঠিক পরিকল্পনা এবং সাহস থাকলে স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হতে পারে।

অভিষেক এবং প্রিয়াঙ্কার বিশ্ব ভ্রমণের গল্প একটি সাহসিক এবং আবেগপ্রবণ যাত্রার উদাহরণ। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত অনেকের জন্য প্রশ্ন উত্থাপন করেছে: স্বপ্ন পূরণের জন্য ঋণ নেওয়া কি সত্যিই মূল্যবান? তাঁদের জন্য, এই অভিজ্ঞতা তাঁদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু আর্থিক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। তাঁদের গল্প আমাদের শেখায়, স্বপ্নের পিছনে ছোটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আর্থিক পরিকল্পনাও অপরিহার্য। আপনি কী ভাবছেন? এই ধরনের ঝুঁকি নেওয়া কি সঠিক, নাকি আর্থিক নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?