শেয়ারবাজারে কারসাজি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করল ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (SEBI)। সংস্থার নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান তুহিন কান্ত পাণ্ডে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বাজার কারসাজির বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” নীতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং এই ধরনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
শুক্রবার মুম্বইয়ে একটি শিল্প সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পাণ্ডে বলেন, “বাজার কারসাজি নিয়ে আমরা আগেও কঠোর ছিলাম, তবে এবার আমরা আরও কঠোর হব। ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনও চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না।”
SME IPO-তে কারসাজির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা:
SEBI চেয়ারম্যানের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এল, যখন ছোট ও মাঝারি শিল্প (SME) সংক্রান্ত প্রাথমিক শেয়ার ইস্যুতে (IPO) কারসাজি নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক মাসে SEBI বহু সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে নির্দেশ জারি করেছে। বেশ কয়েকটি SME কোম্পানির IPO-তে অতিরঞ্জিত সাবস্ক্রিপশন, ভুল তথ্যপ্রকাশ, এবং তহবিলের অপব্যবহারের মতো অনিয়ম উঠে এসেছে। SEBI ও স্টক এক্সচেঞ্জ যৌথভাবে একাধিক IPO-র লঞ্চ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
পাম্প-অ্যান্ড-ডাম্প চক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ:
শুধু SME নয়, মূলধারার বাজারেও কারসাজির প্রবণতা চোখে পড়েছে। বিশেষ করে “পাম্প অ্যান্ড ডাম্প” স্কিমের মাধ্যমে কিছু শেয়ার কৃত্রিমভাবে হাইপ তুলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে, পরে দামে ধস নামিয়ে লোকসানে ফেলা হচ্ছে। এসব চক্রে প্রায়শই সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার হয়।
পাণ্ডে বলেন, “আমরা এই ধরনের অপচেষ্টার ওপর নজর রাখছি। তদন্ত চলছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ডেরিভেটিভ মার্কেটেও নজরদারি:
শুধু ইকুইটি বা IPO নয়, ডেরিভেটিভ মার্কেট, বিশেষ করে ইনডেক্স অপশনেও কারসাজির অভিযোগ উঠে এসেছে। অনেক সময় নির্দিষ্ট সূচকের উপর কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি করে মূল্য হেরফের করানো হয়। SEBI জানিয়েছে, এই ক্ষেত্রেও তদন্ত চলছে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইন থাকলেই চলবে না, দরকার কার্যকর প্রয়োগ:
তুহিন কান্ত পাণ্ডে মন্তব্য করেছেন, শুধুমাত্র নিয়মকানুন দিয়ে বাজারের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও লোভ থেকেই অনেক সময় বাজারে অনিয়ম ঘটে। তিনি বলেন, “লোভ একটি চিরন্তন মানবিক বৈশিষ্ট্য। এটি মহাভারত বা রামায়ণেও দেখা যায়। কেবল নিয়ম করে তা রোধ করা যায় না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “সমাধান হচ্ছে কার্যকর আইন প্রয়োগ ও সময়মতো হস্তক্ষেপ। অতিরিক্ত নিয়ম চাপিয়ে দিলে ব্যবসায়িক পরিবেশ ব্যাহত হতে পারে।”
জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কাণ্ডে SEBI-র পদক্ষেপ:
গত এপ্রিল মাসে SEBI জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিরুদ্ধে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। সংস্থার প্রোমোটার অনমোল সিং জগ্গির বিরুদ্ধে সরকারি NBFC—PFC ও IREDA—থেকে নেওয়া ঋণ ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে। এছাড়াও, শেয়ারের দামে কৃত্রিমভাবে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ছিল।
SEBI শুধু প্রোমোটারদের বাজারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেনি, বরং সংস্থার বোর্ড থেকেও তাদের সরিয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপ বাজারে স্বচ্ছতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য আশ্বাস:
সম্মেলনে পাণ্ডে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “আজও হয়তো কোথাও অনিয়ম ঘটছে, কিন্তু যারা দোষী, তারা ধরা পড়বে এবং শাস্তি পাবে। কেউ রেহাই পাবে না।”
SEBI-র এই অবস্থান বাজারে স্বচ্ছতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অতীতের তুলনায় এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরও সক্রিয়, বিশেষ করে ডিজিটাল নজরদারি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে। ভবিষ্যতে কারসাজি রোধে এই উদ্যোগ আরও জোরদার হবে বলেও মত বিশ্লেষকদের।
শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখা SEBI-র অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তুহিন কান্ত পাণ্ডের নেতৃত্বে SEBI স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—বাজার কারসাজির জায়গা নেই। নিয়মিত নজরদারি, শক্তিশালী তদন্ত ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ভারতীয় পুঁজিবাজার আরও স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে, এটাই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।