ভারতীয় রেলওয়ে দেশের বাণিজ্যিক ও যাত্রী পরিবহনের জন্য একটি অপরিহার্য জীবনরেখা। ৬২,৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি রুট নিয়ে এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রেল মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় রেলওয়ের চলমান দূরত্ব ৬৯,১৮১ কিলোমিটার। এই বিশাল নেটওয়ার্ক প্রতিদিন ২ কোটিরও বেশি যাত্রী বহন করে এবং বছরে এক বিলিয়ন টনের বেশি মাল পরিবহন করে। এই ক্ষেত্রে ভারত চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সঙ্গে একটি বিশেষ ক্লাবে যোগ দিয়েছে।
ভারতীয় রেলওয়ে ৭,৩০৮টিরও বেশি স্টেশন পরিচালনা করে এবং প্রতিদিন ১৩,০০০টির বেশি ট্রেন চালায়। এই স্টেশনগুলো প্ল্যাটফর্ম টিকিট, দোকান এবং বিজ্ঞাপনের মতো বিভিন্ন উৎস থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করে। তবে প্রশ্ন উঠছে, ভারতের সবচেয়ে ধনী রেলওয়ে স্টেশন কোনটি? ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের (এফওয়াই) তথ্য অনুযায়ী, নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন দেশের ১০০টি সবচেয়ে ব্যস্ত এবং সর্বোচ্চ আয়কারী স্টেশনের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে।
নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন: আয়ের শীর্ষে
রেল মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩৯,৩৬২,২৭২ জন যাত্রী থেকে ৩,৩৩৭ কোটি টাকারও বেশি আয় করেছে। এই স্টেশনটি শুধুমাত্র সর্বোচ্চ আয়কারীই নয়, এটি দেশের অন্যতম ব্যস্ততম স্টেশনও। ভবিষ্যতে এটিকে বিশ্বমানের স্টেশনে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর কৌশলগত অবস্থান এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এটিকে যাত্রীদের পছন্দের শীর্ষে রেখেছে।
হাওড়া ও এমজিআর সেন্ট্রাল: দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন। এটি ৬১,৩২৯,৩১৯ জন যাত্রী থেকে ১,৬৯২ কোটি টাকারও বেশি আয় করেছে। হাওড়া শুধুমাত্র আয়ের দিক থেকে নয়, যাত্রী সংখ্যার দিক থেকেও শীর্ষে রয়েছে। এটি পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এবং প্রতিদিন প্রায় ১০ লক্ষ যাত্রী এখান দিয়ে যাতায়াত করে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে চেন্নাইয়ের এমজিআর সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন, যিনি ৩০,৫৯৯,৮৩৭ জন যাত্রী থেকে ১,২৯৯ কোটি টাকা আয় করেছে। এই তিনটি স্টেশন দেশের শীর্ষ ১০০টি স্টেশনের মধ্যে বার্ষিক আয় এবং যাত্রী ভিড়ের মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
অন্যান্য ধনী স্টেশন
নতুন দিল্লি, হাওড়া এবং এমজিআর সেন্ট্রালের পরে যে স্টেশনগুলো উল্লেখযোগ্য আয় করেছে, সেগুলো হলো:
সেকেন্দ্রাবাদ: ২৭,৭৭৬,৯৩৭ জন যাত্রী থেকে ১,২৭৬ কোটি টাকা।
হজরত নিজামুদ্দিন: ১৪,৫৩৭,৬৮৬ জন যাত্রী থেকে ১,২২৭ কোটি টাকা।
মুম্বইয়ের লোকমান্য তিলক টার্মিনাল (এলটিটি): ১৪,৬৮০,৩৭৯ জন যাত্রী থেকে ১,০৩৬ কোটি টাকা।
আমেদাবাদ: ১৮,২৬০,০২১ জন যাত্রী থেকে ১,০১০ কোটি টাকা।
মুম্বই সিএসএমটি: ৫১,৬৫২,২৩০ জন যাত্রী থেকে ৯৮২ কোটি টাকা।
এই স্টেশনগুলো সবই এনএসজি-১ (নন-সাবআর্বান গ্রেড-১) শ্রেণীভুক্ত। এছাড়াও, দিল্লির আনন্দ বিহার (৮৪৪ কোটি টাকা, ১২,২৩৫,২৭৫ যাত্রী) এবং মহারাষ্ট্রের পুনে (৯৭৬ কোটি টাকা, ২২,২৫৬,৮১২ যাত্রী) শীর্ষ ১০০ আয়কারী স্টেশনের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
রেলওয়ে স্টেশনের শ্রেণীবিভাগ
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেলওয়ে স্টেশনগুলোর শ্রেণীবিভাগ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর করা হয়। তথ্য অনুযায়ী, উত্তর রেলওয়ের ১৬টি স্টেশন শীর্ষ ১০০ আয়কারী স্টেশনের তালিকায় রয়েছে। এরপর রয়েছে দক্ষিণ রেলওয়ের ১৫টি, সেন্ট্রাল রেলওয়ের ১১টি, ইস্ট সেন্ট্রাল রেলওয়ের ৯টি, পূর্ব রেলওয়ের ৭টি এবং উত্তর মধ্য রেলওয়ের ৬টি স্টেশন।
মুম্বই সিএসএমটি: যাত্রী ভিড়ে এগিয়ে
মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনাস (সিএসএমটি) আয়ের দিক থেকে শীর্ষ তিনে না থাকলেও যাত্রী সংখ্যার দিক থেকে এটি উল্লেখযোগ্য। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এই স্টেশন ৫১,৬৫২,২৩০ জন যাত্রী থেকে ৯৮২ কোটি টাকা আয় করেছে। এটি একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান এবং মুম্বইয়ের পরিবহন নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ভারতীয় রেলওয়ের গুরুত্ব
ভারতীয় রেলওয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মহানগর পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করে, মানুষ, পণ্য এবং সম্পদের চলাচল সহজ করে। রেলওয়ে শুধুমাত্র পরিবহনের মাধ্যম নয়, এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নেরও একটি বড় উৎস।
নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের এই অসাধারণ আয় ভারতের গতিশীল গতিশীলতার প্রমাণ। এর পাশাপাশি হাওড়া এবং এমজিআর সেন্ট্রালের মতো স্টেশনগুলো তাদের আঞ্চলিক গুরুত্ব এবং যাত্রী পরিষেবার মাধ্যমে রেলওয়ের আয়ে অবদান রাখছে। তবে এই স্টেশনগুলোর আধুনিকীকরণ এবং যাত্রী সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নতুন দিল্লি স্টেশনকে বিশ্বমানের স্টেশনে রূপান্তরের পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। এছাড়া হাওড়া এবং এমজিআর সেন্ট্রালের মতো স্টেশনগুলোও আধুনিকীকরণের জন্য তালিকায় রয়েছে। রেল মন্ত্রকের লক্ষ্য হলো যাত্রীদের আরও উন্নত সুবিধা প্রদান করা এবং রেলওয়ের আয় আরও বৃদ্ধি করা।
শেষ পর্যন্ত, নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন তার আয় এবং যাত্রী সংখ্যার দিক থেকে ভারতের ধনীতম স্টেশন হিসেবে শীর্ষে থাকলেও, হাওড়া, এমজিআর সেন্ট্রাল এবং মুম্বই সিএসএমটির মতো স্টেশনগুলো তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।