রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI) বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ২০২৪-২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ভারতীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অর্থনীতির অগ্রগতির এই ধারা বজায় থাকবে, যার পেছনে রয়েছে ভোক্তা চাহিদার পুনরুত্থান, শক্তিশালী কর্পোরেট ও ব্যাঙ্কিং খাতের ব্যালেন্স শিট এবং আর্থিক শর্তাবলির সহজতর হওয়া।
চাহিদা, বিনিয়োগ ও নীতির সমন্বয়ে আর্থিক অগ্রগতি
RBI-এর মতে, “২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি উজ্জ্বল। ভোক্তা চাহিদার পুনরুজ্জীবন, সরকারের অব্যাহত মূলধনী ব্যয় এবং আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ এই প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশের মজবুত মৌলিক আর্থিক ভিত্তি, পরিষেবা খাতের স্থিতিস্থাপকতা এবং ভোক্তা ও ব্যবসায়িক আত্মবিশ্বাসের ঊর্ধ্বগতি এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান চালিকা শক্তি। বিশেষত, ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেটে ঘোষিত ‘ন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং মিশন’-এর মাধ্যমে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ নতুন গতি পাবে। এই মিশন দেশীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের শক্তি বৃদ্ধি
RBI জানিয়েছে, বৈশ্বিক বাণিজ্যে ভারতের প্রসারমান ভূমিকা অর্থনীতিকে আরও মজবুত করছে। বর্তমানে দেশটি ১৪টি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) এবং ৬টি পছন্দনীয় বাণিজ্য চুক্তিতে (PTA) যুক্ত রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওমান এবং পেরুর সঙ্গে চলমান আলোচনা ভবিষ্যতে বাণিজ্য প্রবাহে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাণিজ্য চুক্তিগুলি দেশের রপ্তানি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে, যা উৎপাদন খাতের চাহিদা ও কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়াবে।
স্থিতিশীল মুদ্রা, শক্তিশালী ভীত
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতীয় অর্থনীতি বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মাঝেও স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। নির্বাচনের পর সময়ে সরকারের সক্রিয় রাজস্ব ব্যয় এবং পরিকল্পিত মূলধনী ব্যয় আর্থিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। RBI-এর মতে, “ভারতের আর্থিক স্থিতিশীলতা, সীমিত চলতি হিসাব ঘাটতি এবং রাজকোষ ঘাটতির মতো মূল সূচকগুলি রুপি (INR)-এর গতিপথকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে।”
উদীয়মান প্রযুক্তিতে ভারতের নেতৃত্ব
প্রতিবেদনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে—উদীয়মান প্রযুক্তিতে ভারতের আত্মনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা। এই খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবন বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে অগ্রগণ্য অবস্থানে রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিশ্বের মোট রিয়েল-টাইম পেমেন্ট লেনদেনের ৪৮.৫ শতাংশই ভারতে UPI (Unified Payments Interface)-এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এটি ভারতের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রযুক্তি-ভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশের প্রমাণ।
বাজারের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
আর্থিক বাজার সম্পর্কেও RBI আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। তাদের মতে, ভারতীয় ইকুইটি বাজারগুলি মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি ও মূল্যায়নের পরিমিতি বজায় রেখে স্থিতিশীল থাকবে। তবে রিপোর্টে সতর্ক করে বলা হয়েছে, “বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এই অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে কিছুটা ব্যাহত করতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বাণিজ্যিক বিরোধের মতো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিগুলি ভারতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে তেলের দাম ও আমদানি খরচের ক্ষেত্রে।
RBI-এর এই বার্ষিক প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভারতীয় অর্থনীতি একটি সুসংহত ও স্থিতিশীল পথে এগিয়ে চলেছে। নীতিগত উদ্যোগ, পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও শক্তিশালী করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি সরকার তার ব্যয় নীতি ও সংস্কার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে, তবে ভারত আগামী অর্থবছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অন্যতম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।