ভারত সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণের কৌশলের অংশ হিসেবে শীঘ্রই পেট্রোল পাম্প স্থাপনের নিয়ম শিথিল করার কথা ভাবছে। পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক ২০১৯ সালের বিদ্যমান নির্দেশিকা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ইতিমধ্যে একটি চার সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে এবং আগামী ১৪ দিনের মধ্যে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মতামত চেয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন:
কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ভরত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডের (BPCL) সাবেক ডিরেক্টর (মার্কেটিং) সুখমল জৈন। এছাড়াও কমিটিতে রয়েছেন—
পি. মণোজ কুমার, মহাপরিচালক, পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালাইসিস সেল (PPAC)
পি.এস. রবি, প্রতিনিধি, ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি (FIPI)
অরুণ কুমার, ডিরেক্টর (মার্কেটিং), পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক
এই কমিটি ২০১৯ সালের নীতি কতটা কার্যকর হয়েছে তা যাচাই করবে, বিকল্প জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক গতিশীলতার (ই-মোবিলিটি) প্রসারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সুপারিশ করবে এবং বাস্তবায়নে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানের উপায় প্রস্তাব করবে।
২০১৯ সালের নীতি পরিবর্তন:
২০১৯ সালের আগে, ভারতে খুচরা জ্বালানি বিক্রির লাইসেন্স পেতে হলে কোম্পানিগুলিকে অন্তত ২,০০০ কোটি টাকা তেল অনুসন্ধান, শোধনাগার, পাইপলাইন বা এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে হতো বা সেই পরিমাণ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিতে হতো।
২০১৯ সালের সংস্কারে এই যোগ্যতার মানদণ্ড অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়:
খুচরা বাজারে পেট্রোল ও ডিজেল বিক্রি করতে হলে ন্যূনতম ২৫০ কোটি টাকা নেটওয়ার্থ থাকতে হবে এবং তিন বছরের মধ্যে অন্তত একটি বিকল্প জ্বালানি সুবিধা (CNG, LNG, বায়োফুয়েল বা ইভি চার্জিং স্টেশন) স্থাপন করতে হবে।
খুচরা ও বাল্ক—উভয় ক্ষেত্রেই জ্বালানি সরবরাহ করতে চাইলে ন্যূনতম ৫০০ কোটি টাকা নেটওয়ার্থ থাকতে হবে।
এছাড়া, খুচরা লাইসেন্সধারীদের পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত ১০০টি ফুয়েল আউটলেট খুলতে হবে, যার অন্তত ৫ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় হতে হবে।
নতুন পরিবর্তনের লক্ষ্য:
সরকার মনে করছে, বর্তমান নীতির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে ও প্রতিযোগিতা জোরদার করতে বাধা দিচ্ছে। বিশেষ করে বিকল্প জ্বালানির পরিকাঠামো এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের চার্জিং নেটওয়ার্ক দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুন নীতি আরও নমনীয় করলে, ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলিও পেট্রোল পাম্প ব্যবসায় প্রবেশের সুযোগ পাবে, যা গ্রাহকদের জন্য সেবা ও দামের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে রেকর্ড বৃদ্ধি:
ভারতের জ্বালানি আমদানির কৌশলেও বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারি বাণিজ্যিক তথ্য অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছিল। এই প্রবণতা ২০২৫ সালেও অব্যাহত রয়েছে।
CNBC-TV18 সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে (FY26) যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি আগের বছরের তুলনায় ১৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে অপরিশোধিত তেলের রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গড়ে প্রতিদিন ০.২৭১ মিলিয়ন ব্যারেল (mb/d) তেল এসেছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ০.১৮ mb/d।
এই পরিবর্তনের তাৎপর্য:
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানির উৎস বৈচিত্র্যময় করা ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে ভারত তার অপরিশোধিত তেলের বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি থেকে আমদানি করে আসছে। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরবরাহ বিঘ্ন এবং মূল্য ওঠানামার ঝুঁকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে আমদানি বাড়ানো হচ্ছে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল আমদানির একটি বাড়তি সুবিধা হলো—তেলের মান (শেল অয়েল) এবং সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা। ভারতের রিফাইনারিগুলিও ধীরে ধীরে এমন প্রযুক্তিতে অভিযোজিত হচ্ছে যা বিভিন্ন মান ও গ্রেডের অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম।
বিকল্প জ্বালানি ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা:
সরকারের নতুন নীতিমালায় কেবলমাত্র পেট্রোল ও ডিজেল নয়, বরং সিএনজি, এলএনজি, বায়োফুয়েল এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের চার্জিং অবকাঠামোতেও জোর দেওয়া হবে। এতে করে ধীরে ধীরে ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরতা কমানো যাবে এবং দূষণ হ্রাসে সহায়তা হবে।
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, যদি সরকার বিনিয়োগকারীদের জন্য নীতি আরও সহজ করে এবং বিকল্প জ্বালানি খাতে প্রণোদনা দেয়, তবে ভারতের জ্বালানি খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে পারে।
পেট্রোল পাম্প স্থাপনের নিয়ম শিথিল করার সম্ভাবনা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির রেকর্ড বৃদ্ধি—দুটোই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারত তার জ্বালানি কৌশলকে দ্রুত পরিবর্তিত করছে। এর লক্ষ্য হলো—বর্ধমান চাহিদা মেটানো, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সবল, টেকসই জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তোলা।