গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তেল বাজারে (Oil Market) যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যেখানে কিছুদিন আগেও তেল ব্যবসায়ীরা একঘেয়ে ও স্থিতিশীল বাজারের কারণে মুনাফা অর্জনের সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ করছিলেন, সেখানে এখন তারা অতিরিক্ত অস্থিরতার কবলে পড়ে হতাশ। মাত্র দুই-আড়াই সপ্তাহের ব্যবধানে তেলের বাজার শান্ত থেকে উত্তাল হয়ে উঠেছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই অস্থিরতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি এবং ওপেক+-এর অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত।
গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প নতুন করে বিস্তৃত শুল্ক ঘোষণা করেন, যা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধকে আরও তীব্র করে তোলে। এর ঠিক পরদিনই ওপেক+ তেল উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যা বাজারের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত। এই দুই ঘটনার ধাক্কায় মার্কিন তেলের ফিউচার মূল্য প্রায় ৭% কমে যায়, যা রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে সবচেয়ে বড় একক দিনের পতন। তেল বাজারের অস্থিরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক ছয় মাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এই অস্থিরতা থেকে মুনাফা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ও পরস্পরবিরোধী ঘটনাপ্রবাহ তেলের দামকে অপ্রত্যাশিতভাবে ওঠানামা করাচ্ছে। ব্যাংক অফ আমেরিকা কর্পোরেশনের গ্লোবাল কমোডিটিজ প্রধান জর্জ কুলট্রারো বলেন, “এই ধরনের অস্থিরতায় মাঝারি মেয়াদে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা কঠিন, কারণ পরিস্থিতি প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। একটি ২৫% শুল্ক হঠাৎ ১০%, ৫% বা ২%-এ রূপান্তরিত হতে পারে, এমনকি পুরোপুরি স্থগিতও হতে পারে। এটি মূল্য নির্ধারণ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।”
এই অস্থিরতার শিকার হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী, যারা আগে বাজারে উত্তেজনার অভাবে হতাশ ছিলেন। কেইলার ক্যাপিটালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা ব্রেন্ট বেলোট এই বছরের শুরুতে অস্থিরতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমনকি তিনি তেলের বাজারে লাভের সুযোগ না পেয়ে প্রথমবারের মতো ধাতু ব্যবসায় প্রবেশ করেন। কিন্তু হঠাৎ আসা এই অস্থিরতা তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয় এবং তার কিছু বিনিয়োগে লোকসান হয়। তিনি তার ক্লায়েন্টদের কাছে লিখেছেন, “আমি পুরোপুরি ভুল পথে হেঁটেছি। এটা কোনো ছোট ভুল নয়, বরং পুরোদমে দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার মতো। আমি সত্যিই ভেবেছিলাম ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নিয়ে আলোচনা মৃদু হবে।”
এই অস্থিরতা স্বল্পমেয়াদে ব্যবসার পরিমাণ বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে বাজারের তারল্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোং-এর বিশ্লেষক ট্রেসি অ্যালেন জানিয়েছেন, ১১ এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহে তেল ও জ্বালানি বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা ২ বিলিয়ন ডলারের নিট প্রবাহ বের করে নিয়েছেন। ফিউচার বাজারে লেনদেনের পরিমাণ মার্চের শেষের দিকের স্তরে ফিরে গেছে, এবং ডব্লিউটিআই-এর ওপেন ইন্টারেস্ট প্রাথমিক উত্থানের পর কমতে শুরু করেছে। বিনিয়োগকারীরা ট্রাম্পের পরবর্তী শুল্ক নীতির ঝুঁকি নিতে না চাইলে বাজার থেকে সরে যাচ্ছেন।
মারেক্সের সিনিয়র কমোডিটিজ কৌশলবিদ রায়ান ফিটজমরিস বলেন, “এই ধরনের শিরোনাম-চালিত অস্থিরতা সাধারণত বাজারের তারল্যের জন্য ভালো নয়। বিড এবং অফারের ব্যবধান বাড়ছে, লেনদেনের পরিমাণ কমছে, এবং বাজারের অংশগ্রহণকারীরা পিছু হটছে। এটি আরও অস্থিরতার একটি প্রতিক্রিয়া লুপ তৈরি করছে, যা সিস্টেমেটিক ফান্ডগুলোকে বাজারের ওঠানামার উপর ভিত্তি করে তাদের পজিশন সামঞ্জস্য করতে বাধ্য করছে।”
বাণিজ্য যুদ্ধের দ্রুত পরিবর্তনশীল গতিবিধি বিনিয়োগকারীদের বাজারের দৃষ্টিভঙ্গি কয়েক দিনের মধ্যে বারবার পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। আইসিই ফিউচারস ইউরোপের তথ্য অনুযায়ী, ৮ এপ্রিল শেষ হওয়া সপ্তাহে হেজ ফান্ডগুলো ব্রেন্ট তেলের উপর তাদের পজিশন রেকর্ড গতিতে উল্টে দেয়। এদিকে, কমোডিটি ফিউচারস ট্রেডিং কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই)-এর উপর লং-অনলি বাজি ২০০৯ সালের পর সর্বনিম্নে নেমে আসে, যেখানে এক সপ্তাহ আগে এটি ছয় সপ্তাহের সর্বোচ্চে ছিল।
এই তথ্য গণনার পর ট্রাম্প ডজনখানেক দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দেন, এবং চীনের উপর শুল্ক ১৪৫%-এ উন্নীত করেন। তেলের উপর সরাসরি বাজি থেকে সরে এসে ব্যবসায়ীরা এখন স্প্রেড পজিশনে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন, যা তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ। গত সপ্তাহে ডব্লিউটিআই-তে স্প্রেড বাজির সংখ্যা ২০০৭ সালের পর সর্বোচ্চ ছিল, এবং ব্রেন্টে সমতুল্য পজিশন ২০২০ সালের পর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
তেল গ্রাহকদের মধ্যেও অস্থিরতা এড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের বড় খরচগুলো নিশ্চিত করতে চাইছেন। গত সপ্তাহে সোয়াপ ডিলাররা ব্রেন্ট এবং আইসিই গ্যাসয়েলে রেকর্ড পরিমাণ লং পজিশন যোগ করেছে, যা সাধারণত শিল্প ক্রেতাদের হেজিংয়ের ইঙ্গিত দেয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে অস্থিরতার ঝুঁকি এড়াতে তাদের প্রচেষ্টার প্রতিফলন।
অন্যদিকে, বড় দামের পতন শুরু হতে পারে শুল্কের মতো মৌলিক কারণে, কিন্তু অপশন মার্কেট এবং ট্রেন্ড-ফলোয়িং ফান্ডের পজিশনিংয়ের মতো অন্যান্য কারণে এটি আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে। ব্রিজটন রিসার্চ গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, শুল্ক-প্ররোচিত বাজার পতনের পরবর্তী পাঁচ দিনে কমোডিটি ট্রেডিং অ্যাডভাইজাররা ডব্লিউটিআই-তে ১০০% শর্ট পজিশনে চলে যায়। এর ঠিক আগে, তারা ২৮ মার্চ থেকে ধীরে ধীরে আরও বুলিশ হয়ে লং পজিশন শুরু করার চেষ্টা করছিল। এটি ২০২৩ সালে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের পর থেকে সবচেয়ে নাটকীয় পজিশন পরিবর্তন।
ব্যাংকটির পতনের পরের মাসগুলোতে তেল ব্যবসায়ীদের জন্য একাধিক মুনাফার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তেলের দাম প্রথমে প্রায় ২০% কমে যায়, তারপর ৪০% বেড়ে বছরের নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। অ্যাগেইন ক্যাপিটালের অংশীদার জন কিলডাফ বলেন, “একঘেয়ে বাজার বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি, তা নতুন মাত্রার জটিলতা নিয়ে এসেছে। আপনি যদি কষ্ট এবং অস্থিরতা পছন্দ করেন, তাহলে এই বাজার আপনার জন্যই।”
এই অস্থিরতা তেল বাজারের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনও অনিশ্চিত। ব্যবসায়ীদের জন্য এটি একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে বড় ঝুঁকি। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, বাজার এখন যে গতিতে চলছে, তাতে সফল হতে হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা অপরিহার্য।