মুম্বাইয়ের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (World Trade Centre Mumbai) এবং অল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডাস্ট্রিজ (AIAI) যৌথভাবে আয়োজিত এক বিশেষ ইন্টার্যাক্টিভ সেশনে বুধবার ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (MSME) এবং স্টার্টআপগুলির জন্য ভারতীয় ডাক (India Post)-এর বৈশ্বিক লজিস্টিক নেটওয়ার্ক কীভাবে আন্তর্জাতিক রপ্তানিকে আরও সহজ, সাশ্রয়ী এবং কার্যকরী করে তুলতে পারে—সেই বিষয়েই ছিল মূল ফোকাস।
সেশনে ভারতীয় ডাক কর্তৃপক্ষ জানায়, রপ্তানিকারকদের জন্য তারা চালু করেছে বিশেষ উদ্যোগ ‘ডাকঘর নির্যাত কেন্দ্র’। এই কেন্দ্রগুলিতে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও কমপ্লায়েন্সে বিনামূল্যে সহায়তা দেওয়া হয়। কাস্টমস বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই কেন্দ্র রপ্তানিকারকদের দামী এজেন্টের উপর নির্ভরশীলতা দূর করছে।
মহারাষ্ট্র সার্কেলের চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল অমিতাভ সিংহ জানান, “আমাদের লক্ষ্য হলো ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য রপ্তানি সহজ করা। এখানে সব ধরনের সহায়তা একেবারে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। আমদানি-রপ্তানি কোড পাওয়া থেকে শুরু করে ডকুমেন্টেশন পর্যন্ত সবকিছুর জন্য আর অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না।”
রপ্তানি প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুততর করার জন্য মুম্বাইয়ে ভারতীয় ডাক নিজস্ব কাস্টমস এবং ড্রাগ কন্ট্রোল অফিস গড়ে তুলেছে। এর ফলে ওষুধসহ নানা ধরনের পণ্য দ্রুত প্রসেস করা সম্ভব হচ্ছে। একইসঙ্গে বিনামূল্যে পিক-আপ সার্ভিস, নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ করা হয়েছে রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে।
বর্তমানে ভারতীয় ডাক ১৩০টিরও বেশি দেশের ডাকবিভাগের সঙ্গে পার্টনারশিপ করেছে, যাতে বিশ্বজুড়ে দৃশ্যমানতা এবং লজিস্টিক দক্ষতা আরও বাড়ানো যায়।
উল্লেখযোগ্যভাবে, এই সেশনটি আয়োজিত হলো এমন এক সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় আমদানির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার মুম্বাইয়ের চেয়ারম্যান বিজয় কালান্ত্রি বলেন, “এক দরজা বন্ধ হলে তিন দরজা খোলে। আমাদের আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, জিসিসি (GCC) দেশ ও সিআইএস (CIS) অঞ্চলের বাজারে নজর দেওয়া উচিত।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিশ্বের ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের গার্মেন্টস রপ্তানি বাজারে ভারতের অংশ মাত্র ১৮-২০ বিলিয়ন ডলার। ফলে টেক্সটাইল, চামড়া, রত্ন ও গয়না, কৃষি-ভিত্তিক পণ্যে ভারতের জন্য বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
কালান্ত্রি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকেও প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে—যেমন জিএসটি হ্রাস, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্বাক্ষর, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চলমান আলোচনা। ভারতীয় ডাকের উদ্যোগ সেই প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং ভারতের লজিস্টিক খরচ বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় যে বেশি, তা কমাতে সাহায্য করবে।
কর্পোরেট বাণিজ্য আইনজীবী মুকুন্দ পুরাণিক এই উদ্যোগকে ‘গেম-চেঞ্জার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, “১৩০টি দেশে ভারতীয় ডাকের লজিস্টিক সুবিধা অন্য যেকোনও পরিষেবার তুলনায় কম খরচে পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে ছোট রপ্তানিকারকরা স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি—দুই ক্ষেত্রেই লাভবান হবেন।”
তিনি আরও আশাবাদী যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান শুল্ক বিরোধ অচিরেই মিটবে। কারণ ভারত সংযত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশ ভারতের পাশে রয়েছে। “এটি একেবারেই অস্থায়ী ধাপ। আমাদের এক বা দুই দেশের উপর নির্ভরশীল না হয়ে বহুমুখী বাজারে প্রবেশ করতে হবে,” বলেন পুরাণিক।
জৈব কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক শেঠকর ভিতচারে জানান, ভারতীয় ডাকের এই নতুন সুবিধা প্রবাসী ভারতীয়দের চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, “বিদেশে ভারতীয় প্রক্রিয়াজাত ও তাজা খাদ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ছোট কনসাইনমেন্ট পাঠানো সবসময় কঠিন ছিল। এখন মাত্র ৩৫ কেজি ওজনের চালানও সহজে পাঠানো যাবে। এর ফলে প্রবাসী ভারতীয় এবং স্থানীয় গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে।”
ভারতীয় ডাকের এই নতুন পদক্ষেপ শুধু রপ্তানি নয়, আমদানির ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাবে, অন্যদিকে ভারতের লজিস্টিক খরচ হ্রাস পাবে। বর্তমান বৈশ্বিক শুল্ক পরিস্থিতিতে এ উদ্যোগ ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য সত্যিই এক সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে।