মুকেশ আম্বানি (Mukesh Ambani) — রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক — দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ও বৈচিত্র্যময় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গঠনের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি ম্যাকিন্সির গৌতম কুমরার সঙ্গে “Leading Asia” শীর্ষক এক সাক্ষাৎকারে, তিনি রিলায়েন্সের ভবিষ্যৎ ভাবনা, মূলনীতি, এবং নেতৃত্ব দর্শন নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন।
এই সাক্ষাৎকারে মুকেশ আম্বানি জানিয়েছেন, কিভাবে স্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, উপযুক্ত দল, এবং প্রযুক্তির সুচারু ব্যবহার একটি সংস্থাকে উদ্ভাবনী শক্তিতে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে। তার মতে, নেতৃত্ব মানেই সাহসিকতা, প্রযুক্তির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানুষে বিশ্বাস।
পিতার দৃষ্টিভঙ্গির ছায়া:
মুকেশ আম্বানি তার নেতৃত্বগুণের জন্য পিতা ধীরুভাই আম্বানির প্রেরণা ও দর্শনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। “আমার বাবা ১৯৬০ সালে মুম্বাই এসেছিলেন মাত্র $100, একটি চেয়ার, একটি টেবিল এবং একটি টেলিফোন নিয়ে,” তিনি বলেন। “কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল—ভারতের জন্য কিছু বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু গড়ে তোলা।” সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই ১৯৭০-এর দশকে পলিয়েস্টার টেক্সটাইল থেকে শুরু করে ২০২০-এর দশকে সবুজ শক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-তে বিনিয়োগ, রিলায়েন্স আজ একটি বহুমাত্রিক প্রযুক্তি-ভিত্তিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
ধীরুভাইয়ের প্রবাদ, “যদি আপনি বিলিয়নিয়ার হতে ব্যবসা শুরু করেন, তাহলে আপনি নির্বোধ। কিন্তু আপনি যদি এক বিলিয়ন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে চান, তাহলে সাফল্যের সুযোগ অনেক বেশি,” এই চিন্তাধারাই আজও রিলায়েন্সের নীতির মূলমন্ত্র।
ঝুঁকি নয়, সাহসী উদ্যোগ:
রিলায়েন্স বরাবরই ঝুঁকি নিতে ভয় পায়নি। ২০১৬ সালে জিও-তে $২৫ বিলিয়ন বিনিয়োগ ছিল তেমনই এক সাহসী পদক্ষেপ, যা অনেক বিশ্লেষকের মতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। “অনেকে বলেছিলেন, ভারত এখনো প্রস্তুত নয়। কিন্তু আমি বোর্ডকে বলেছিলাম, ‘আমরা যদি কিছুই না পাই, তবুও ভারতের ডিজিটালীকরণ হবে আমাদের সেরা দান।’” আজ সেই জিও-র বাজারমূল্য প্রায় $১০০ বিলিয়ন এবং এটি ৫০ কোটির বেশি গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে।
তিনি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ সূত্র তুলে ধরেন—“আপনাকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও টিকে থাকতে হবে। যদি আপনি সেটা পারেন, তাহলে বড় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়।”
প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের স্বপ্ন:
আম্বানি বিশ্বাস করেন, রিলায়েন্স ভবিষ্যতে একটি “ডীপ-টেক ও অ্যাডভান্সড ম্যানুফ্যাকচারিং” কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে। ৫জি প্রযুক্তি থেকে শুরু করে সৌরশক্তি, হাইড্রোজেন ও ব্যাটারিভিত্তিক সবুজ শক্তি ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ, সবকিছুতেই প্রযুক্তিকে কেন্দ্রে রেখেই এগোচ্ছে রিলায়েন্স। “আমরা এখন আর প্রযুক্তি ব্যবহারকারী নই, আমরা প্রযুক্তির মালিক,” বলেন তিনি।
এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের সেরা প্রতিভা আকর্ষণে সহায়তা করছে। “আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট—জটিল সমস্যার সমাধান এবং জাতীয় সম্পদ তৈরি করা।”
মানুষে আস্থা, প্রতিভার বিকাশ:
মানবসম্পদ গঠনে আম্বানির তিনটি মূলনীতি—চরিত্র, দক্ষতা ও সংস্কৃতি। তার মতে, “চরিত্র দক্ষতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দক্ষতা তৈরি করা যায়।”
রিলায়েন্সে নতুন কর্মীদের প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত করা হয়। “যখন তারা এই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তারা এটা ছাড়তে পারে না। আর একবার আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলে, আমরা তাদের সমস্ত বিষয়ে যত্ন নিই।”
কাঠামো ও সিস্টেমে নমনীয়তা:
একটি সফল সংস্থা গঠনের জন্য কাঠামো ও সিস্টেমকে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অনুযায়ী সংলগ্ন করার গুরুত্ব তুলে ধরেন মুকেশ আম্বানি। “ব্যক্তিকে সীমাবদ্ধ করে অভ্যাস। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানকে সীমাবদ্ধ করে তার সিস্টেম। নমনীয়তা নিশ্চিত করে যে আমরা আমাদের সম্ভাবনাকে সীমিত করছি না।”
এই কারণে রিলায়েন্স প্রতি কয়েক বছর পরপর তার কৌশল পুনর্গঠন করে। ভারতের পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোম্পানিকে প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর রাখাই এই নমনীয় নীতির মূল লক্ষ্য।
ভবিষ্যতের দিকে দৃঢ় অঙ্গীকার:
২০২৭ সালে রিলায়েন্স তাদের ৫০তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করবে। তবে মুকেশ আম্বানির দৃষ্টি সেই সীমানায় থেমে নেই। “আমার বাবা বলেছিলেন, ‘রিলায়েন্স তোমার আর আমার পরেও টিকে থাকতে হবে।’ সেটাই আমার প্রতিশ্রুতি।”
এই বিস্তৃত কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি বিষয়—লক্ষ্যপ্রসূ নেতৃত্ব। ডিজিটাল পরিকাঠামোর রূপান্তর, সবুজ শক্তির ভবিষ্যৎ গঠন অথবা সাধারণ প্রতিভা থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি—যে কাজেই হোক, আম্বানির দর্শন এক ও অভিন্ন৷