মধ্যম স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা কী চান? বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকৃত কণ্ঠস্বর

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অষ্টম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন (8th CPC Demand) নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। বিশেষ করে মধ্যম স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা, যারা প্রশাসনের মেরুদণ্ড হিসেবে…

8th Pay Commission Salary Hike for Teachers in India 2025

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অষ্টম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন (8th CPC Demand) নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। বিশেষ করে মধ্যম স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা, যারা প্রশাসনের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা এই কমিশনের কাছ থেকে ন্যায্য বেতন বৃদ্ধি ও আর্থিক সুবিধার প্রত্যাশা করছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দিয়েছে, যা ২০২৬ বা ২০২৭ সাল থেকে কার্যকর হতে পারে। এই কমিশনের লক্ষ্য হলো প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন সংশোধন করা। তবে মধ্যম স্তরের কর্মকর্তারা, যারা লেভেল ৬ থেকে ১০-এর মধ্যে কাজ করেন, তাঁদের প্রত্যাশা ও দাবি নিয়ে আলোচনা এখন সর্বত্র।

মধ্যম স্তরের কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা
মধ্যম স্তরের কর্মকর্তারা, যেমন ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, সেকশন অফিসার এবং গ্রুপ এ অফিসার (যেমন সহকারী কমিশনার বা আইএএস, আইপিএস-এর প্রাথমিক স্তর), তাঁদের বেতন বৃদ্ধির জন্য একটি ন্যায্য ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর (fitment factor) চান। সপ্তম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, যা ২০১৬ সালে বেতন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১৪.৩% বৃদ্ধি এনেছিল। কিন্তু এবার কর্মচারী ইউনিয়নগুলো দাবি করছে ৩.০ থেকে ৩.৫ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, যা বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ ৩০-৩৪% পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন লেভেল ৬-এর কর্মকর্তা, যাঁর বর্তমান মূল বেতন ৩৫,৪০০ টাকা, তিনি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে ১,০১,২৪৪ টাকা বেতন পেতে পারেন। এই বৃদ্ধি তাঁদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও কাজের প্রতি উৎসাহ বাড়াবে বলে মনে করছেন অনেকে।

   

মূল দাবিগুলো কী?
ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মধ্যম স্তরের কর্মকর্তাদের কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা যায়, তাঁদের দাবিগুলো কেবল বেতন বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁরা চান:
১. মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন বৃদ্ধি: গত নয় বছরে মুদ্রাস্ফীতি ৪-৭% এর মধ্যে থাকায় প্রকৃত অর্থের মূল্য কমেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে বেতন বৃদ্ধি না হলে জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা কঠিন।

২. ভাতার সংস্কার: মহার্ঘ ভাতা (DA), গৃহভাড়া ভাতা (HRA), এবং ভ্রমণ ভাতা (TA) এর সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে DA মূল বেতনের ৫৫% এবং ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে এটি ৭০% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। কিন্তু অষ্টম সিপিসি কার্যকর হলে DA শূন্যে নামবে, তাই কর্মকর্তারা চান এই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য উচ্চ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর।

৩. পে স্কেল একীকরণ: ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (JCM) প্রস্তাব করেছে লেভেল ১ থেকে ৬-এর পে স্কেল একীকরণ করতে, যাতে কর্মীদের মধ্যে বেতনের অসঙ্গতি কমে এবং ক্যারিয়ারের অগ্রগতি সহজ হয়।

৪. পেনশন সুবিধা বৃদ্ধি: মধ্যম স্তরের কর্মকর্তারা চান পেনশন সংশোধন যেন মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। বর্তমানে ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা, যা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে ২৫,৭৪০ টাকায় উন্নীত হতে পারে।

৫. কর্মক্ষেত্রে সুবিধা: আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত প্রশিক্ষণ, এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুবিধার উন্নতি চান তাঁরা।

Advertisements

ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর
দিল্লির একজন সেকশন অফিসার বলেন, “আমাদের দায়িত্ব বেড়েছে, কিন্তু বেতন মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। অষ্টম সিপিসি আমাদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে সাহায্য করবে।” কলকাতার একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “আমরা চাই বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি HRA এবং TA বাড়ুক, কারণ শহরে বসবাসের খরচ বেড়েই চলেছে।” মুম্বইয়ের একজন সাব-ইন্সপেক্টর বলেন, “কাজের চাপ এবং ঝুঁকি অনেক, তাই আমরা আশা করছি অষ্টম সিপিসি আমাদের পেশাগত জীবনকে আরও সুরক্ষিত করবে।”

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, স্বচ্ছ বেতন কাঠামো এবং ক্যারিয়ারের অগ্রগতির সুযোগ চাই।” উত্তর-পূর্ব ভারতের একজন কর্মচারী বলেন, “দুর্গম এলাকায় কাজ করার জন্য বিশেষ ভাতা বাড়ানো উচিত।”

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও, এর চূড়ান্ত সুপারিশ এবং বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিছু সূত্রের মতে, ২০২৬ সালের জানুয়ারির সময়সীমা মিস হতে পারে, কারণ কমিশনের সদস্য এবং চেয়ারপার্সন এখনও নিযুক্ত হননি। এছাড়াও, সরকারকে প্রায় ২.৪ থেকে ৩.২ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা বহন করতে হবে, যা বাজেট বরাদ্দের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর মধ্যে জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (JCM) ইতিমধ্যে সুপারিশ পেশ করেছে, যার মধ্যে পে স্কেল একীকরণ এবং DA-এর একটি অংশ মূল বেতনে যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। তবে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও অপেক্ষমাণ।

সমাজের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, মধ্যম স্তরের কর্মকর্তারা দেশের প্রশাসন চালানোর মূল শক্তি, তাই তাঁদের দাবি পূরণ করা সরকারের দায়িত্ব। অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, অত্যধিক বেতন বৃদ্ধি সরকারের উপর আর্থিক চাপ বাড়াবে, যা সাধারণ জনগণের উপর করের বোঝা হিসেবে ফিরে আসতে পারে।

অষ্টম বেতন কমিশন মধ্যম স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে। তাঁদের দাবি—ন্যায্য বেতন বৃদ্ধি, ভাতার সংস্কার, এবং কর্মক্ষেত্রে উন্নত সুবিধা—শুধু আর্থিক নয়, দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা ও কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই দাবিগুলো পূরণে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, তা নির্ভর করবে আগামী মাসগুলোতে কমিশনের সুপারিশ এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা এই কণ্ঠস্বরগুলো স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, অষ্টম সিপিসি কেবল একটি আর্থিক সংস্কার নয়, এটি দেশের মধ্যম স্তরের কর্মকর্তাদের আশা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন।