বর্তমানে ভারতের গ্রাহক আর্থিক ব্যবস্থায় ‘নো-কস্ট ইএমআই’ (No-Cost EMI) এক নতুন বিপ্লব এনেছে। স্মার্টফোন, ফ্রিজ, টেলিভিশন থেকে শুরু করে ভ্রমণের খরচ পর্যন্ত—যেকোনো বড় কেনাকাটায় এখন অনেক সময়েই “নো-কস্ট ইএমআই” এর সুবিধা পাওয়া যায়। অতিরিক্ত সুদ ছাড়াই মাসিক কিস্তিতে টাকা শোধ করার এই সুযোগ যেন অনেকটাই স্বপ্নপূরণের দ্বার খুলে দেয় সাধারণ মানুষের জন্য। তবে এর পেছনে লুকিয়ে থাকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বাস্তবতা আছে, যেগুলি না বোঝার ফলে গ্রাহকরা ভবিষ্যতে চরম আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
নো-কস্ট ইএমআই: আদতে কতটা “নো কস্ট”?
নাম শুনে মনে হতে পারে, এই ইএমআই-তে কোনো সুদ নেই, কিন্তু বাস্তবে এই সুবিধাটি পুরোপুরি ‘বিনামূল্যে’ নয়। গ্রাহকের কাছ থেকে সরাসরি সুদ না নিলেও, সেই খরচটি বিক্রেতা, প্রস্তুতকারক সংস্থা বা ফাইনান্স পার্টনার বহন করে, অথবা পণ্যের দামে আগেই সুদের টাকা যোগ করে রাখা হয়। একে বলা হয় ‘ডিলার সাবভেনশন’, যা সাধারণত টু-হুইলার এবং কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স বিক্রির ক্ষেত্রে দেখা যায়। এখানে ইএমআই-এর সুদের ভার ব্যবসায়ী বা প্রস্তুতকারক বহন করেন, কিন্তু সেই খরচটি ঘুরপথে পণ্যের দামে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
ঋণ গ্রহণ সহজ, কিন্তু দায়িত্বও বড়
নো-কস্ট ইএমআই-এর সহজলভ্যতা অনেক তরুণ পেশাদার ও প্রথমবার ঋণ গ্রহণকারীদের আকৃষ্ট করছে। তাদের কাছে এটি শুধুমাত্র একটি কেনাকাটার উপায় নয়, বরং একটি ক্রেডিট প্রোফাইল গড়ে তোলার মাধ্যমও। নিয়মিত ও সময়মতো কিস্তি শোধ করলে ক্রেডিট স্কোর উন্নত হয়, যা ভবিষ্যতে বড় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
তবে, এখানে একটি ফাঁদও লুকিয়ে আছে। যেহেতু ইএমআই-এর প্রক্রিয়া সহজ এবং কম টাকার লেনদেন হওয়ায় অনেকেই একাধিক নো-কস্ট ইএমআই গ্রহণ করে ফেলেন। ফলত, খুব অল্প সময়ে তাদের নামের সঙ্গে অনেকগুলো ঋণের হিসাব জমা হয়, যা ক্রেডিট রিপোর্টে দেখা যায়। যদি আপনার আয় সেই সমস্ত ঋণ পরিশোধের তুলনায় কম হয়, তাহলে ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আপনার ঋণগ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হতে পারে।
একটি কিস্তি মিস করলে কী হতে পারে?
অনেকেই মনে করেন ছোট ইএমআই মিস হলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু বাস্তবটা একেবারেই ভিন্ন। ধরুন, কোনো একজন গ্রাহকের তিনটি ঋণ আছে—একটি হোম লোন এবং দুটি কনজিউমার লোন (একটি ফোন ও একটি টিভি কেনার জন্য)। যদি তিনি মোবাইল ফোনের কিস্তি দিতে দেরি করেন, তাহলে ক্রেডিট রিপোর্টে দেখা যাবে ৩টির মধ্যে ১টি ঋণে ডিফল্ট হয়েছে। এই অনিয়মিততা কিন্তু তার সামগ্রিক ক্রেডিট স্কোরে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে। ছোট কিস্তি বলেই সেটিকে অবহেলা করা এক মারাত্মক ভুল।
হার্ড ইনকোয়ারি এবং ক্রেডিট স্কোরের প্রভাব
প্রতিবার আপনি কোনো নো-কস্ট ইএমআই গ্রহণ করার সময়, ফাইনান্স সংস্থাগুলি আপনার ক্রেডিট রিপোর্টে একটি হার্ড ইনকোয়ারি করে। যদি একাধিকবার আপনি এই ধরণের আবেদন করেন, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক ইনকোয়ারি আপনার স্কোর কমাতে পারে। অনেক বেশি হার্ড ইনকোয়ারি ঋণদাতাদের মনে সন্দেহ তৈরি করে যে আপনি আর্থিক সমস্যায় আছেন বা অতিরিক্ত ঋণের ওপর নির্ভরশীল।
আয় এবং ঋণের ভারসাম্য রক্ষা জরুরি
নো-কস্ট ইএমআই যেমন জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে, তেমনই এর অতি ব্যবহার আপনাকে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলতে পারে। একটি ভালো আর্থিক অভ্যাস হলো—আপনার মাসিক আয়ের এমন একটা অংশেই ইএমআই সীমাবদ্ধ রাখা যাতে তা সহজেই সামলানো যায়। সাধারণভাবে বলা হয়, মোট ইএমআই আপনার মাসিক আয়ের ৩০–৪০% এর মধ্যে থাকা উচিত।
সচেতনতা এবং নিয়মিত ক্রেডিট রিপোর্ট পর্যবেক্ষণই মূল চাবিকাঠি
আপনি যদি নিয়মিত নিজের ক্রেডিট রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে সময়মতো জানতে পারবেন কোথায় আপনি অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছেন বা কোথায় কোনো কিস্তি বাদ পড়েছে। আজকাল বেশিরভাগ ক্রেডিট ব্যুরো বিনামূল্যে বছরে একবার ক্রেডিট রিপোর্ট দেখার সুবিধা দেয়। এই অভ্যাস আপনাকে কেবল ভালো স্কোর বজায় রাখতে সাহায্য করবে না, বরং ভবিষ্যতে বড় ঋণের আবেদন করার সময় বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
‘ক্রেডিট সক্ষমতা সৃষ্টি করে ভোগক্ষমতা’—এই অর্থনৈতিক দর্শনকে আজ বাস্তবায়িত করছে নো-কস্ট ইএমআই। এটি যদি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকটাই উন্নত হতে পারে। কিন্তু এই ব্যবস্থার অপব্যবহার করলে, যা আখেরে ঋণের বোঝা ও আর্থিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই বলাই যায়, নো-কস্ট ইএমআই একদিকে যেমন আপনার স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি হতে পারে, তেমনই অসচেতন হলে সেটিই হতে পারে আপনার ঋণের ফাঁদ। সময় এসেছে সচেতনভাবে অর্থ ব্যবস্থাপনার।