ব্রেন ড্রেন সমস্যা! কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলি প্রতিভার ঘাটতির সম্মুখীন

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা (Kolkata) বিশেষ করে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ, রাজারহাট এবং নিউ টাউনের মতো এলাকাগুলি ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তবে,…

How Competitive Are IT Fresher Jobs in Kolkata for 2025

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা (Kolkata) বিশেষ করে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ, রাজারহাট এবং নিউ টাউনের মতো এলাকাগুলি ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলের আইটি কোম্পানিগুলি একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে—প্রতিভার ঘাটতি এবং ব্রেন ড্রেন বা দক্ষ পেশাদারদের বহির্গমন। অনেক দক্ষ আইটি পেশাদার বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, পুনে বা বিদেশের মতো উন্নত বাজারের দিকে চলে যাচ্ছেন, যা কলকাতার আইটি শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই সমস্যার কারণ, প্রভাব এবং সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা করব।

ব্রেন ড্রেনের কারণ
কলকাতার আইটি শিল্পে প্রতিভার ঘাটতির পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ এবং পুনের মতো শহরগুলি ভারতের আইটি শিল্পের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। এই শহরগুলি উচ্চ বেতন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং গ্লোবাল এক্সপোজার প্রদান করে, যা কলকাতার তুলনায় তরুণ পেশাদারদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। দ্বিতীয়ত, কলকাতায় নতুন প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং সাইবারসিকিউরিটির মতো ক্ষেত্রে দক্ষ পেশাদারদের অভাব রয়েছে। এই দক্ষতার ঘাটতি কোম্পানিগুলির জন্য প্রকল্প সম্পন্ন করা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন করে তুলছে।

   

তৃতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিল্পের মধ্যে একটি বড় ফাঁক রয়েছে। কলকাতার অনেক শিক্ষার্থী কম্পিউটার সায়েন্স বা আইটি-সংক্রান্ত ডিগ্রি অর্জন করলেও, তাদের মধ্যে অনেকেই শিল্পের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে ‘জব-রেডি’ হয় না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোম্পানিগুলিকে প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করতে হয়, যা সময় এবং অর্থের অপচয় ঘটায়। এছাড়াও, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, দীর্ঘ যাতায়াতের সময় এবং শহুরে অবকাঠামোর সমস্যা (যেমন ট্র্যাফিক জ্যাম, জলাবদ্ধতা) তরুণ পেশাদারদের কলকাতা ছেড়ে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে।

প্রভাব
ব্রেন ড্রেন এবং প্রতিভার ঘাটতি কলকাতার আইটি শিল্পের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। প্রথমত, কোম্পানিগুলি নতুন প্রকল্প শুরু করতে বা বিদ্যমান প্রকল্প সম্পন্ন করতে বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছে। এটি তাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারাতে বাধ্য করছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষ কর্মীদের অভাবে কোম্পানিগুলিকে উচ্চ বেতন এবং একাধিক ইনক্রিমেন্ট প্রদান করতে হচ্ছে, যা তাদের অপারেশনাল খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তৃতীয়ত, কলকাতার আইটি শিল্পের খ্যাতি এবং বৃদ্ধির সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ বড় কোম্পানিগুলি বিনিয়োগের জন্য অন্য শহর বা দেশ বেছে নিচ্ছে।

এই সমস্যা শুধুমাত্র কোম্পানির উপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতির উপরও। আইটি শিল্প পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিভার ঘাটতি এবং ব্রেন ড্রেনের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে, যা তরুণদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সমাধানের পথ
কলকাতার আইটি শিল্পে প্রতিভার ঘাটতি এবং ব্রেন ড্রেন মোকাবেলায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, শিক্ষাব্যবস্থাকে শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলিতে এআই, মেশিন লার্নিং, সাইবারসিকিউরিটি এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মতো নতুন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে কোর্স চালু করা উচিত। এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টার্নশিপ এবং হ্যান্ডস-অন প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো দরকার।

Advertisements

দ্বিতীয়ত, কোম্পানিগুলিকে দক্ষ কর্মী ধরে রাখার জন্য আকর্ষণীয় বেতন, নমনীয় কাজের সময়, দূরবর্তী কাজের সুযোগ এবং স্বাস্থ্য ও সুস্থতা প্রোগ্রাম প্রদান করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যেই হাইব্রিড কাজের মডেল গ্রহণ করছে, যা কর্মীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে। তৃতীয়ত, সরকার এবং শিল্প সংস্থাগুলির মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো দরকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত আইটি শিল্পের জন্য প্রণোদনা প্রদান করা, যেমন কর সুবিধা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং স্টার্টআপদের জন্য সহায়তা।

চতুর্থত, স্থানীয় স্টার্টআপ এবং উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলিকে উৎসাহিত করা উচিত। কলকাতায় ইতিমধ্যেই কিছু স্টার্টআপ এবং আইটি কোম্পানি, যেমন ইওয়াই, অ্যাকসেনচার এবং উইপ্রো, সফলভাবে কাজ করছে। তবে, আরও নতুন কোম্পানিকে আকর্ষণ করতে হলে কলকাতাকে একটি ‘টেক হাব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর জন্য শহরের অবকাঠামো, যেমন রাস্তা, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এবং ইন্টারনেট সংযোগ, উন্নত করা প্রয়োজন।

পঞ্চমত, মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল এবং সার্টিফিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই প্রোগ্রামগুলি স্বল্প সময়ে নির্দিষ্ট দক্ষতা শেখানোর জন্য ডিজাইন করা হয়, যা কোম্পানিগুলির জন্য খরচ-কার্যকর সমাধান হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলি স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করে এআই বা সাইবারসিকিউরিটির উপর স্বল্পমেয়াদী কোর্স চালু করতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কলকাতার আইটি শিল্পের সম্ভাবনা অপার। শহরটি ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি বড় আইটি কোম্পানির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে, এবং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে এটি ভারতের অন্যতম প্রধান টেক হাব হয়ে উঠতে পারে। তবে, এর জন্য সরকার, শিল্প এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্রেন ড্রেন রোধ করতে তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং শহরের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে।

কলকাতার আইটি শিল্প ব্রেন ড্রেন এবং প্রতিভার ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও, সঠিক কৌশল এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম, নমনীয় কাজের পরিবেশ এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে কলকাতা তার আইটি শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। এই শহরের তরুণ প্রতিভাদের ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে সকল পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।