রাশিয়ার তেলে ভারতের লাভের অঙ্ক নিয়ে গুজব! উত্তর দিল কেন্দ্র

গত কয়েক বছর ধরে ভারতের তেল আমদানি বাজারে রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া…

Oil Imports

গত কয়েক বছর ধরে ভারতের তেল আমদানি বাজারে রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া যখন তাদের তেল সস্তায় বিক্রি করতে শুরু করেছিল, তখন ভারত এই সুযোগ নিয়ে বড় পরিমাণে রাশিয়ান ক্রুড তেল আমদানি (Russian Oil Import) করেছে। এই সস্তা তেলের মাধ্যমে ভারতের অর্থনৈতিক লাভ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া ও বিশ্লেষকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। কিছু মিডিয়া রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে ভারত প্রতি বছর ১০ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো লাভ করছে, কিন্তু সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে এই অঙ্কটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবার এই বিষয়ে মুখ খুলেছে এবং সত্যিকারের পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেছে।

ক্রেডিট সুইস (CLSA) নামক একটি আন্তর্জাতিক ব্রোকারেজ ফার্মের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের রাশিয়ান তেল আমদানি থেকে বাস্তব লাভ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার (করমর্দন ব্যতীত) বা মোট ২০,০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এই পরিমাণটি মিডিয়ার দাবির তুলনায় অনেক কম, যেখানে ১০ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো উচ্চ হিসাব দেওয়া হয়েছিল। CLSA-র রিপোর্টে জানানো হয়েছে যে, রাশিয়ান তেলের ছাড় (discount) গত বছরগুলোতে ক্রমশ কমে গেছে। FY24-এ প্রতি ব্যারেলে ৮.৫ ডলার ছাড় থাকলেও, FY25-এ এটি ৩ থেকে ৫ ডলারে নেমে এসেছে এবং বর্তমানে প্রায় ১.৫ ডলারে সীমাবদ্ধ। এই কম ছাড় এবং পরিবহন, বীমা ও অন্যান্য খরচের কারণে ভারতের মোট লাভ অনেক কমে গেছে।

   

কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার মাধ্যমে আমরা আমাদের জ্বালানি সরবরাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। তবে এটি এমন কোনো বড় অর্থনৈতিক লাভের উৎস নয়, যেমনটি কিছু মিডিয়া প্রচার করেছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের জ্বালানি খরচ কমানো, তবে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ও বিভিন্ন বাধা এর উপর প্রভাব ফেলে।” এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, সরকার মিডিয়ার অতিরঞ্জিত দাবির বিরোধিতা করছে।

রাশিয়ান তেল ভারতের মোট তেল আমদানির ৩৬ থেকে ৪০ শতাংশ অংশ জুড়ে আছে, যা প্রতিদিন ১.৫ থেকে ১.৮ মিলিয়ন ব্যারেলের কাছাকাছি। এই পরিমাণ তেলের মাধ্যমে ভারত গ্লোবাল তেল বাজারে একটি স্থিতিশীল ভূমিকা রাখছে। CLSA-র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি ভারত রাশিয়ান তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়, তবে গ্লোবাল তেল সরবরাহে প্রায় ১% (১ মিলিয়ন ব্যারেল/দিন) কমে যাবে, যার ফলে তেলের দাম ৯০ থেকে ১০০ ডলার প্রতি ব্যারেলে চলে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের জ্বালানি খরচ আরও বাড়তে পারে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

Advertisements

তবে এই তথ্যের মধ্যে একটি চিন্তার বিষয় হলো, এই সস্তা তেলের লাভ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছোয়নি। জ্বালানি মূল্যের দাম কমানোর পরিবর্তে, বর্তমানে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম এখনও উচ্চতর স্তরে রয়েছে। এই বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, “রাশিয়া থেকে সস্তা তেল এলে আমাদের জ্বালানি দাম কেন কমে না?” এর উত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর মধ্যে বাধা সৃষ্টি করে বিভিন্ন কর ও বিনিয়োগ। তবে এই ব্যাখ্যা অনেকের কাছে সন্তোষজনক মনে হচ্ছে না।

অন্যদিকে, ভারত-আমেরিকা সম্পর্কে এই তেল আমদানির কারণে একটি চাপ তৈরি হয়েছে। আমেরিকা ভারতের উপর রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসার জন্য শুল্ক বৃদ্ধি (৫০% পর্যন্ত) আরোপ করেছে, যা ভারতীয় রঙিন ও গয়না শিল্পের মতো খাতকে ক্ষতি করছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে তার জিওপলিটিকাল কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, ভারতকে মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকা থেকে আরও তেল আমদানি বাড়াতে হবে, যাতে একটি সুষম সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।

সর্বোপরি, রাশিয়ান তেলের লাভের অঙ্ক নিয়ে গুজবের মধ্যে সত্যি কতটুকু, তা স্পষ্ট হয়েছে CLSA-র রিপোর্টে। তবে এই বিষয়ে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং জ্বালানি মূল্যে স্বস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা কীভাবে এগোবে, তা নিয়ে চাহিদা বাড়ছে। ভারতের জনগণ এখন এই সিদ্ধান্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছে, যা তার অর্থনৈতিক ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।