ভারত-আমেরিকার বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জারি করা এক্সিকিউটিভ অর্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ২৫ আগস্ট, ২০২৫ থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী প্রায় সব ডাকসেবা সাময়িকভাবে স্থগিত (India US mail ban)করার ঘোষণা দিয়েছে। কেবলমাত্র চিঠি, নথিপত্র ও সর্বোচ্চ ১০০ মার্কিন ডলার মূল্যের উপহার পার্সেল পাঠানো যাবে, এর বাইরে আর কোনো ডাক সামগ্রী যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো সম্ভব হবে না।
৩১ জুলাই, ২০২৫ তারিখে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা যেকোনো বিদেশি পণ্য যার মূল্য ১০০ মার্কিন ডলারের বেশি, সেসবের উপর শুল্ক আরোপ করা হবে। এর ফলে ভারতীয় রপ্তানি পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কার্যকর হয়। দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিশেষ সুবিধায় শুল্কমুক্ত অবস্থায় প্রবেশ করত। কিন্তু নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বড় ধাক্কা খেয়েছেন।
মার্কিন শুল্ক ও সীমান্ত সুরক্ষা বিভাগ (CBP) আন্তর্জাতিক ডাক ও কার্গো পরিবহন সংস্থাগুলিকে জানিয়ে দেয় যে, এখন থেকে প্রতিটি যোগ্য সংস্থা (qualified party) শুল্ক আদায়, সংরক্ষণ ও প্রেরণের জন্য দায়ী থাকবে। কিন্তু এ সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক কাঠামো এখনো স্পষ্ট নয়। ফলে, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য পরিবহন সংস্থাগুলো ভারতীয় ডাকবিভাগকে জানিয়ে দেয় যে তারা আপাতত যুক্তরাষ্ট্রগামী ডাক গ্রহণ করতে পারবে না।
ভারত পোস্ট জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির কারণে কার্যত ডাকপ্রেরণ ও পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, শুল্ক সংগ্রহ ব্যবস্থা ও তথ্য বিনিময়ের কাঠামো না থাকায় ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো পার্সেল পাঠানো সম্ভব নয়। তাই ২৫ আগস্ট থেকে ডাকবিভাগ কেবল নথিপত্র ও ১০০ ডলারের নিচে মূল্যমানের উপহার গ্রহণ করবে।
পোস্টাল বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “CBP গত ১৫ আগস্ট কিছু প্রাথমিক নির্দেশনা দিলেও, এখনো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যেমন শুল্ক সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স মেকানিজম স্পষ্ট নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রগামী বিমান সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তারা ভারত থেকে ডাকসামগ্রী নিতে পারবে না।”
এই সিদ্ধান্তে ভারতীয় প্রবাসীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। লাখো ভারতীয় পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজনকে যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, উৎসবের উপহার কিংবা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ডাকের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকে। এখন কেবল চিঠি ও সীমিত পরিমাণ উপহার পাঠানো যাবে। ফলে ছাত্রছাত্রী, প্রবাসী কর্মী ও ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়বেন।
ব্যবসায়ী মহলও উদ্বিগ্ন। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি রপ্তানিকারকরা ডাক ও কুরিয়ারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে হ্যান্ডমেড সামগ্রী, পোশাক, কারুশিল্প ও অন্যান্য হালকা পণ্য পাঠিয়ে থাকেন। নতুন নিয়মের ফলে তাদের বাজার সংকুচিত হবে। ভারতীয় রপ্তানি পরিষদ (FIEO) জানিয়েছে, এ ধরনের সিদ্ধান্তে বছরে কয়েকশো কোটি টাকার রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ মূলত ভারতকে চাপ দেওয়ার কৌশল। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, ভারত তার বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তন এনে মার্কিন কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি সুবিধা দিক। ভারত এ বিষয়ে আপস না করায় হোয়াইট হাউস শুল্ক বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছে। ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা কূটনৈতিক পর্যায়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় আছি। আশা করি দ্রুত সমাধান হবে।”
ডাকবিভাগ স্পষ্ট করেছে যে, এই সিদ্ধান্ত সাময়িক। যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র তার শুল্ক আদায় ও তথ্য বিনিময়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রগামী ডাকসেবা সীমিত থাকবে। তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সমাধান পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।
কলকাতার বাসিন্দা সুমিতা দত্ত, যিনি তাঁর মেয়ের কাছে ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়মিত মিষ্টি ও বই পাঠান, বলেন, “এখন যদি কিছু পাঠাতে হয়, ১০০ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কারণ আমরা উৎসবের সময় বেশি কিছু পাঠাতে চাই।”
একইভাবে, বেঙ্গালুরুর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রোহিত মুখার্জি জানান, “আমার ছোট স্টার্টআপ যুক্তরাষ্ট্রে ক্লায়েন্টদের হাতে তৈরি জিনিস পাঠাত। ডাকসেবা বন্ধ হওয়ায় আমাদের কাজ বড় ধাক্কা খেল।”
ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক বহুদিন ধরেই বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। শুল্ক বাড়ানো থেকে শুরু করে ডেটা লোকালাইজেশন ইস্যু—বিভিন্ন কারণে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ চলছে। ডাকসেবা স্থগিত হওয়া সেই দ্বন্দ্বেরই সাম্প্রতিক উদাহরণ।
সরকারি পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদী অনেকে। তবে সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে আপাতত এটি বড় ধরনের ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।