ভারতের আর্থিক বাজারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলোর একটি হল, যুব পেশাজীবীদের মধ্যে ডিজিটাল লোন (India digital loan) নেওয়ার হার বেড়ে যাওয়া। বিভিন্ন ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম, অ্যাপ-ভিত্তিক ঋণদাতা, ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং ফিনান্স কোম্পানির (NBFC) রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট, ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যুবক-যুবতীরাই এখন দেশের ডিজিটাল লোন মার্কেটের সবচেয়ে বড় গ্রাহকগোষ্ঠী। কর্মসংস্থান, নগরায়ণ, দ্রুত জীবনযাপন, অনলাইন কেনাকাটা, এবং জরুরি খরচ—সব মিলিয়ে ডিজিটাল লোনের চাহিদা ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে প্রকাশিত ফিনটেক অডিট রিপোর্ট বলছে, ভারতের মোট ব্যক্তিগত ঋণের মধ্যে ৪২% এসেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ ২৫–৩৫ বছর বয়সী চাকরিজীবী, ফ্রিল্যান্সার, টেক কর্মী, BPO কর্মী এবং প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ভারতের “আধুনিক আর্থিক আচরণ” এখন আর ব্যাঙ্কের লম্বা লাইন নয়; বরং মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেই ঋণ পাওয়া, EMI ক্যালকুলেশন করা, KYC সম্পন্ন করা এবং তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
এই প্রবণতার মূল কারণ তিনটি—সহজলভ্যতা, গতি এবং কম ডকুমেন্টেশন। ডিজিটাল লোন অ্যাপগুলিতে সাধারণত কয়েকটি বেসিক ইনফরমেশন দিলেই লোন অনুমোদন হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে টাকা ৩০ মিনিটের মধ্যেই অ্যাকাউন্টে ঢুকে যায়। কর্মজীবনে নতুন, মধ্যম আয়ের যুবক-যুবতীদের জন্য এটি বড় স্বস্তির।
২০২৫ সালে ভারতীয় সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া ড্রাইভ এবং ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশনের জোরদার পদক্ষেপও ডিজিটাল লোন ব্যবহারে বড় ভূমিকা রেখেছে। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত জনসংখ্যার পরিমাণ বেড়েছে, UPI ট্রান্স্যাকশনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন আরও স্বচ্ছ হয়েছে, আর KYC ডিজিটাল হওয়ায় লোন নেওয়া সহজ হয়েছে।
অন্যদিকে, ক্রেডিট স্কোর ও ডিজিটাল footprint এখন নতুন যুগের আর্থিক পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম এখন ব্যবহারকারীর খরচাচালি, সময়মতো বিল পরিশোধ, রেন্ট পেমেন্ট, সাবস্ক্রিপশন—এসব দেখে ক্রেডিটওয়ার্থিনেস নির্ধারণ করছে। ফলে প্রথমবারের লোনগ্রহীতাদেরও সহজে ঋণ মিলছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুবকদের এই ঋণ-নির্ভরতার কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান প্রজন্মের জীবনযাপন আগের থেকে অনেক দ্রুততর। হঠাৎ খরচ, স্বাস্থ্যব্যয়, ভ্রমণ, গ্যাজেট কেনা, ভাড়া দেওয়া, স্টার্টআপে বিনিয়োগ, স্কিল আপগ্রেড কোর্স, এবং মাসিক নগদপ্রবাহের (cash-flow) ঘাটতি মেটাতেই তারা ডিজিটাল লোন বেশি নিচ্ছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে—
- ৩৫% যুবক ব্যক্তিগত খরচ মেটাতে ছোট EMI লোন নিচ্ছেন
- ২৬% নিচ্ছেন স্মার্টফোন/ল্যাপটপ কেনার জন্য
- ১৮% নিচ্ছেন স্বাস্থ্য জরুরী পরিস্থিতি সামলাতে
- ১৫% নিচ্ছেন ভ্রমণ বা বিলাসী খরচের জন্য
- ৬% নিচ্ছেন ব্যবসা বা স্টার্টআপ শুরু করতে
ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলোও যুবকদের লক্ষ্য করেই ‘Buy Now, Pay Later’ (BNPL), Micro-loan, Sachet loan, 24×7 Instant Credit–এর মতো লোন স্কিম চালু করেছে। মাসে ৩,০০০–৫,০০০ টাকার EMI এখন অনেকের কাছে স্বাভাবিক খরচের মতো, এবং তারা মনে করেন—“মাসিক EMI দিয়ে দিলেই হল।”
এই ডিজিটাল লোন ব্যবস্থার সুবিধা যেমন আছে, ঝুঁকিও তেমনি রয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে বিভিন্ন রাজ্যে এমন ঘটনা দেখা গিয়েছে যেখানে যুবক-যুবতীরা একাধিক অ্যাপ থেকে লোন নিয়ে পরে EMI দিতে না পেরে আর্থিক চাপে পড়ে গিয়েছেন। অনেক ফিনটেক কোম্পানি উচ্চ সুদ, লুকানো চার্জ, আগাম-পেমেন্ট ফি বা হার্ড রিকভারি মডেল ব্যবহারের অভিযোগে আলোচনায় এসেছে।
২০২৫ সালে রিজার্ভ ব্যাংক এই খাতে পর্যবেক্ষণ জোরদার করেছে এবং বলেছে—“ডিজিটাল লেন্ডিং হবে স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং নিয়ম মেনে।”
তবে সমস্ত উদ্বেগ সত্ত্বেও বাস্তব চিত্র বলছে—ভারতের চাকরিজীবী তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল ঋণের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ এটি দ্রুত, সুবিধাজনক এবং তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান দেয়। পূর্ববর্তী প্রজন্মের মতো “সঞ্চয় করে পরে কেনা”—এই আচরণ বদলে গিয়ে হয়েছে—“এখন কেনো, পরে শোধ করো।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সালে ভারতের ডিজিটাল লোন বাজার ৪৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে, যার বড় অংশই পরিচালনা করবে শহর ও শহরতলির তরুণ কর্মজীবী শ্রেণি। এই প্রবণতা ভারতীয় অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে—একদিকে ব্যয় বাড়বে, অর্থনৈতিক গতি বাড়বে; অন্যদিকে অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ততার ঝুঁকিও থাকবে।
সব মিলিয়ে, ভারতের ডিজিটাল লোন নীতি, শহুরে জীবনযাপন এবং যুবকদের আর্থিক মানসিকতা—এই তিনের মিশ্রণে ২০২৫ সাল হবে “India’s Digital Credit Boom”–এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এই পুরো বাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন—ভারতের তরুণ পেশাজীবীরা।
