জল জীবনের জন্য অপরিহার্য। এটি শরীরের প্রধান কার্যক্রমগুলিকে সমর্থন করে এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, যা আমাদের শরীর নিজে উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলিতে, বিশেষ করে বেঙ্গালুরুর মতো মহানগরীতে, মানুষ উদ্বিগ্ন যে পানীয় জল বিষাক্ত, দূষিত এবং স্বাস্থ্যের জন্য অসুরক্ষিত হয়ে উঠছে। এই উদ্বেগের মধ্যে ভারতের খাদ্য সুরক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (এফএসএসএআই) একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
এফএসএসএআই প্রায় ১৬০টি প্যাকেটজাত জলের (Packaged Water ) বোতলের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে ১০০টিরও বেশি নমুনার রিপোর্ট ইতিমধ্যে প্রাপ্ত হয়েছে এবং এই রিপোর্টে দেখা গেছে যে পরীক্ষিত নমুনার ৫০ শতাংশ জল পানের জন্য অসুরক্ষিত। এই তথ্য স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
রিপোর্টে কী বলা হয়েছে?
প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্যাকেটজাত জল পানের জন্য অনুপযুক্ত। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এই জলর নমুনায় ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জল সংরক্ষণের ফলে এতে ছত্রাকের উপাদান বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, কিছু কোম্জল দূষিত জল এবং বোরওয়েলের জল বোতলে ভরে বাজারে বিক্রি করছে বলে জানা গেছে।
রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে জল পরিশোধন না করেই বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে, যার ফলে এতে বিপজ্জনক উপাদানের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। এই ধরনের দূষিত জল পান করলে বমি, ডায়রিয়া, জ্বর এবং ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। খাদ্য সুরক্ষা বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলি দ্রুত স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
দূষণের কারণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
এফএসএসএআই-এর তদন্তে দেখা গেছে যে, অনেক কোম্জল জলর গুণগত মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পরীক্ষিত নমুনায় ই-কোলাই এবং কলিফর্মের মতো ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা সাধারণত দূষিত জলাশয় বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে আসে। এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে বোতলে সংরক্ষিত জলতে ছত্রাক বা ফাঙ্গাল উপাদানের বৃদ্ধি দেখা গেছে, যা জলর গুণমানকে আরও খারাপ করেছে।
কিছু বোরওয়েল থেকে সরাসরি জল সংগ্রহ করে কোনও পরিশোধন প্রক্রিয়া ছাড়াই বোতলজাত করে বিক্রি করছে। এই জলতে ভারী ধাতু এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি থাকতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলীর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্য সুরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, এই ধরনের জল পানের ফলে শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে দ্রুত সংক্রমণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষতি হতে পারে।
কেন এই সমস্যা বাড়ছে?
বেঙ্গালুরুর মতো মহানগরীতে জলর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রা কমে যাওয়া এবং জলাশয় দূষণের কারণে অনেকে প্যাকেটজাত জলর উপর নির্ভর করছেন। কিন্তু এই বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে অনেক কোম্জল নিম্নমানের জল সরবরাহ করছে। তদন্তে দেখা গেছে, কিছু কোম্জল খরচ কমাতে পরিশোধন প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ ভুয়ো সার্টিফিকেশন দেখিয়ে বাজারে পণ্য বিক্রি করছে।
এছাড়া, প্যাকেটজাত জলর বোতলগুলি প্রায়ই দীর্ঘ সময় ধরে দোকানে বা গুদামে সংরক্ষিত থাকে। উচ্চ তাপমাত্রা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই বোতলগুলিতে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের বৃদ্ধি ঘটে। এই সমস্যা এড়াতে জলর গুণমান পরীক্ষা এবং সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেক কোম্জল মানছে না।
এফএসএসএআই-এর পদক্ষেপ
এই রিপোর্ট প্রকাশের পর এফএসএসএআই কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে। যে সমস্ত কোম্জলর নমুনা অসুরক্ষিত বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া, বাজারে প্যাকেটজাত জলর গুণমান নিয়মিত পরীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এফএসএসএআই-এর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে কোনও আপস করব না। যে কোম্জলগুলি নিয়ম লঙ্ঘন করছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে এবং জরিমানা আরোপ করা হবে।”
এছাড়া, এফএসএসএআই জনসাধারণের জন্য একটি সতর্কতা জারি করেছে। তারা পরামর্শ দিয়েছে যে, প্যাকেটজাত জল কেনার আগে বোতলের উৎপাদন তারিখ, মেয়াদ শেষের তারিখ এবং এফএসএসএআই সার্টিফিকেশন চিহ্ন যাচাই করা উচিত। যদি জলর রং বা গন্ধে কোনও অস্বাভাবিকত্ব দেখা যায়, তবে তা পান না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
বেঙ্গালুরুতে এই রিপোর্ট প্রকাশের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। অনেকে জানিয়েছেন যে, তারা প্রতিদিনের প্রয়োজনে প্যাকেটজাত জলর উপর নির্ভর করেন, কিন্তু এখন তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। একজন বাসিন্দা বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম প্যাকেটজাত জল নিরাপদ, কিন্তু এখন দেখছি তাও বিশ্বাস করা যায় না। সরকারের উচিত এই কোম্জলগুলির উপর কঠোর নজর রাখা।”
শিশুদের অভিভাবকরা বিশেষভাবে চিন্তিত। একজন মা জানিয়েছেন, “আমার বাচ্চারা স্কুলে প্যাকেটজাত জল নিয়ে যায়। এখন থেকে আমি নিজে ফিল্টার করা জল বোতলে ভরে দেব।” অনেকে বাড়িতে ওয়াটার পিউরিফায়ার ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন, যদিও এটি সবার জন্য সাশ্রয়ী সমাধান নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, দূষিত জল শুধু স্বল্পমেয়াদী সমস্যাই নয়, দীর্ঘমেয়াদী রোগের কারণও হতে পারে। ডা. প্রিয়া রাও, একজন পুষ্টিবিদ, বলেন, “দূষিত জল পান করলে শরীরে টক্সিন জমতে পারে, যা ক্যানসার বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতার মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের উচিত জলর গুণমান নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো।”
এফএসএসএআই-এর এই রিপোর্ট প্যাকেটজাত জলর নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। যে কোম্জলগুলি ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে খেলছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। একইসঙ্গে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং নিরাপদ জলর উৎস নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। জল জীবনের ভিত্তি, এবং এর গুণমান নিয়ে কোনও আপস করা উচিত নয়। এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত, ভোক্তাদের নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।