জিএসটি সংস্কারে অভিষেকের দাবিকে মান্যতা দিল মোদী সরকার!

দীর্ঘদিনের অভিযোগ এবং সমালোচনার পর আজ মোদী সরকারের কাছ থেকে একটি বড় সংস্কারের ঘোষণা এসেছে জিএসটি ব্যবস্থায় (GST Reforms 2025)। ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে বিমা…

GST Reforms 2025: Modi Govt Acknowledges Abhishek Banerjee’s Demands, Slashes Taxes for Common Man

দীর্ঘদিনের অভিযোগ এবং সমালোচনার পর আজ মোদী সরকারের কাছ থেকে একটি বড় সংস্কারের ঘোষণা এসেছে জিএসটি ব্যবস্থায় (GST Reforms 2025)। ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে বিমা প্রিমিয়াম এবং লোনের কিস্তিতে সবকিছুর উপর ভারী করের চাপ চাপিয়ে দিয়েছিল মোদী সরকার। এই জিএসটিকে তারা ‘কর্পোরেটের নাম’ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাম্প্রতিককালে লোকসভায় তাঁর জোরালো বক্তব্যে কেন্দ্রীয় নীতির তীব্র সমালোচনা করে ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, এই কর ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের উপর অত্যধিক বোঝা চাপিয়েছে এবং এটি অবিলম্বে সংস্কারের প্রয়োজন। আজকের সংস্কার ঘোষণায় অনেকেই মনে করছেন যে, এটি অভিষেকের দাবিকেই মান্যতা দিয়েছে। বুধবার জিএসটি কাঠামোতে বড় সংস্কারের ঘোষণা করে মোদী সরকার এক ধাক্কায় অনেক জিনিসের দাম অনেকাংশে কমিয়েছে, যা সাধারণ নাগরিক, মধ্যবিত্ত এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য বড় স্বস্তির খবর।

স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সংস্কারের উল্লেখ করেন। ১৫ আগস্ট লাল কেল্লা থেকে দেশবাসীকে সম্বোধন করে তিনি বলেছিলেন, “আমরা জিএসটির পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কার আনছি, যা দেশজুড়ে করের বোঝা কমাবে। এই দীপাবলিতে এটি দ্বিগুণ উপহার হিসেবে আসবে।” এই ঘোষণার পর থেকেই আলোচনা চলছিল যে, সরকার কীভাবে জিএসটির জটিল কাঠামোকে সরল করবে। আজ বুধবারের ঘোষণায় সরকার জানিয়েছে যে, বর্তমান চারটি স্ল্যাব (৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%) থেকে এটি দুটি প্রধান স্ল্যাবে (৫% এবং ১৮%) রূপান্তরিত হবে। ২৮% স্ল্যাবটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে, এবং ‘সিন’ গুডস বা বিলাসবহুল পণ্যের জন্য একটি নতুন ৪০% স্ল্যাব চালু হবে। এতে প্রায় ৯৯% পণ্য যা বর্তমানে ১২% করের আওতায় আছে, তা ৫% স্ল্যাবে চলে যাবে, এবং ৯০% পণ্য যা ২৮% এ ছিল, তা ১৮% এ নেমে আসবে। এই পরিবর্তন অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে, যা দীপাবলির আগেই সাধারণ মানুষের পকেটে স্বস্তি আনবে।

   

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা ছিল খুবই তীব্র। লোকসভায় তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “মোদী সরকার জিএসটির নামে কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের উপর এমনিতেই মুদ্রাস্ফীতি এবং করের চাপে জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। ক্রয়-বিক্রয় থেকে বিমা, লোনের কিস্তি—সবকিছুতে কর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি অর্থনৈতিক অবিচার।” তৃণমূল কংগ্রেসের এই সমালোচনা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিপক্ষ দলগুলো, বিশেষ করে কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দল, জিএসটির জটিলতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছে। রাহুল গান্ধীও বলেছিলেন যে, এটি ‘অর্থনৈতিক অবিচার’। কিন্তু আজকের ঘোষণায় সরকার যেন অভিষেকের দাবিকে মেনে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কার তৃণমূলের মতো দলের চাপের ফল।

এই সংস্কারের প্রভাব কী হবে? প্রথমত, দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম কমবে। উদাহরণস্বরূপ, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, ট্যালকাম পাউডারের মতো পণ্য যা বর্তমানে ১৮% করের আওতায়, তা ৫% এ নেমে আসবে। এতে হিন্দুস্তান ইউনিলিভার বা গোদরেজের মতো কোম্পানির পণ্যগুলো সস্তা হবে, এবং সাধারণ গৃহিণীর পকেটে সাশ্রয় হবে। ছোট গাড়ি, যেমন ১২০০ সিসি-এর নিচের পেট্রোল গাড়ি বা ১৫০০ সিসি-এর নিচের ডিজেল গাড়ি, যা এখন ২৮% কর পায়, তা ১৮% এ নেমে আসবে। হাইব্রিড গাড়ির জন্যও কর কমবে, যা টয়োটা বা সুজুকির মতো কোম্পানির জন্য ভালো খবর। টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স যেমন স্যামসাং বা এলজির পণ্যগুলোর দাম ১০% কমবে। মোটরসাইকেল এবং স্কুটার (৩৫০ সিসি-এর নিচের) যা ৯৫% দ্বিচক্র যানবাহুর বাজার দখল করে, তাদের করও কমবে। কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, ট্রাক্টরের যন্ত্রাংশ—এসবও ৫% বা ১২% থেকে কমবে, যা কৃষকদের জন্য বড় সাহায্য।

বিমা খাতেও বড় পরিবর্তন। স্বাস্থ্য বিমা এবং জীবন বীমার প্রিমিয়ামে বর্তমানে ১৮% জিএসটি, যা এখন কমানোর প্রস্তাব আছে। এতে বিমা প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জন্য বিমা সহজলভ্য হবে। লোনের কিস্তিতে করের চাপ কমলে মধ্যবিত্তের লোন নেওয়া সহজ হবে। এছাড়া, প্যাকেজড ফুড, ওষুধ, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, জুতো, সাইকেল—এসবও ৫% স্ল্যাবে চলে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মুদ্রাস্ফীতি কমবে এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ অনুভূতি সহায় বলেছেন, “এই সংস্কার ভারতের অর্থনীতিকে ০.৩৫ থেকে ০.৪৫ শতাংশ বাড়াতে পারে ২০২৭ অর্থবছরে।”

কিন্তু এই সংস্কারের পেছনে রাজনৈতিক প্রসঙ্গও রয়েছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা সাম্প্রতিক লোকসভা অধিবেশনে সবচেয়ে জোরালো ছিল। তিনি বলেছিলেন, “জিএসটি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্পোরেটরা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু ছোট ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত।” তৃণমূল কংগ্রেসের এই অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছে, যেখানে ছোট ব্যবসায়ীরা জিএসটির জটিলতায় কষ্ট পেয়েছে। আজকের ঘোষণায় সরকার যেন এই চাপ মেনে নিয়েছে। বিপক্ষ নেতারা বলছেন, এটি নির্বাচনী বছরে ভোটারদের আকর্ষণের কৌশল। বিহারে নভেম্বরে নির্বাচন, এবং এই সংস্কার সেখানকার মধ্যবিত্তকে খুশি করবে।

Advertisements

অর্থনৈতিক দিক থেকে এই সংস্কারের প্রভাব বিস্তৃত। জিএসটি কাউন্সিলের গ্রুপ অফ মিনিস্টার্স (গোম) রেট র্যাশনালাইজেশন নিয়ে কাজ করেছে, যার নেতৃত্বে বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী স্মরত চৌধুরী। তারা উল্টো ডিউটি স্ট্রাকচার সংশোধন, শ্রেণিবিভাগের সমস্যা সমাধান এবং রেটের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে। ফলস্বরূপ, ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের জমা কমবে এবং দেশীয় উৎপাদন বাড়বে। এমএসএমই খাতের জন্য এটি বড় সাহায্য, কারণ সরল কমপ্লায়েন্স এবং কম কর খরচ কমাবে। অ্যান্ডারসনের জেমস থম বলেছেন, “এটি আমেরিকার ট্রাম্পের ট্যারিফের প্রভাব মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে এবং ভোক্তা খাতকে পুনরুজ্জীবিত করবে।”

তবে, চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এই সংস্কার সরকারের রাজস্ব কমাতে পারে, যা জিডিপির ০.৪% (প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার)। রাজ্যগুলোর জন্য এটি সমস্যা, কারণ তাদের রাজস্বের উৎস কম। এইচএসবিসির প্রাঞ্জুল ভণ্ডারী বলেছেন, “রাজ্যগুলো এই ক্ষতি মেনে নিতে পারে না, কেন্নদ্র এবং রাজ্যের মধ্যে সমঝোতা দরকার।” তবু, সরকার বলছে যে, ‘সিন’ গুডসের ৪০% কর এবং অন্যান্য উপায়ে রাজস্বের ক্ষতি পূরণ হবে। কয়লা, বেটিং, ক্যাসিনোর মতো খাতে কর বাড়ানো হতে পারে।

এই সংস্কারের ফলে শেয়ার বাজারও উত্তেজিত। অটো, কনজ্যুমার গুডস এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার উঠেছে। মারুতি সুজুকি, হিরো মোটোকর্প, বাজাজ অটোর মতো কোম্পানিরা লাভবান হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযানকে শক্তিশালী করবে এবং রপ্তানি বাড়াবে। যুবকদের বেকারত্ব (১৯%) কমাতে এটি চাকরির সুযোগ তৈরি করবে।

সারাংশে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি যেন মোদী সরকার মেনে নিয়েছে। এই সংস্কার সাধারণ মানুষের জীবন সহজ করবে, অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করবে। তবে, এর সফলতা নির্ভর করবে জিএসটি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এবং রাজ্যের সহযোগিতার উপর। দীপাবলির আগে এই ‘ডাবল বোনান্জা’ সত্যি হলে সাধারণ মানুষের উৎসব হবে আরও উজ্জ্বল।