অ্যাডভান্স রুলিংয়ে বৈপরীত্য, ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে GST

ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোয় সবচেয়ে বড় সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) প্রবর্তন। ২০১৭ সালে চালু হওয়ার সময় এর মূল দর্শন ছিল –…

"concerns-over-12-gst-slab-gom-sitharaman-urgent-meeting

ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোয় সবচেয়ে বড় সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) প্রবর্তন। ২০১৭ সালে চালু হওয়ার সময় এর মূল দর্শন ছিল – “One Nation, One Tax, One Market” অর্থাৎ এক দেশ, এক কর, এক বাজার। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্যের একাধিক পরোক্ষ কর যেমন এক্সাইজ ডিউটি, সার্ভিস ট্যাক্স, ভ্যাট (VAT) ইত্যাদি একীভূত হয়ে একটি統 ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে কর কাঠামোয় একরূপতা এসেছে এবং উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত কর প্রদানে ‘ক্যাসকেডিং ইফেক্ট’ বা করের উপর কর চাপার প্রবণতা অনেকাংশে কমেছে।

৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জিএসটি-কে দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জানান, শিগগিরই একটি ব্যাপক জিএসটি সংস্কার আসছে, যা তিনি দেশের মানুষের জন্য “দীপাবলির উপহার” বলে অভিহিত করেছেন।

   

সরকারের প্রস্তাব অনুযায়ী, বহুল আলোচিত বহুমাত্রিক করহার (multi-rate structure) তুলে দিয়ে দুটি স্তরে করহার নির্ধারণের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষত নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সাধারণ পণ্যের ওপর করহার কমানো হবে। এর ফলে ইনভার্টেড ডিউটি স্ট্রাকচার (যেখানে ইনপুটের ওপর করহার বেশি অথচ প্রস্তুত পণ্যে কর কম) সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞ মহল। টেক্সটাইল, জুতো, সার, ভোজ্য তেলের মতো খাতে এ ধরনের অসামঞ্জস্য বহুদিন ধরেই শিল্পকে সমস্যায় ফেলেছিল।

জিএসটির অন্যতম লক্ষ্য ছিল সরবরাহ শৃঙ্খলে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট (ITC)-এর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে নানা কারিগরি সমস্যায় করদাতারা বিপাকে পড়েছেন। যেমন, কোনো কোম্পানি যদি সংযুক্তিকরণ বা একত্রীকরণের মাধ্যমে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়, তবে অব্যবহৃত আইটিসি স্থানান্তরের অনুমতি নেই। এর ফলে করদাতাদের বড় অঙ্কের আইটিসি ক্ষতি হয়।

সম্প্রতি বোম্বে হাইকোর্টের গোয়া বেঞ্চ Umicore Autocat India মামলায় রায় দিয়েছে যে, আন্তঃরাজ্য সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে আইটিসি স্থানান্তরযোগ্য। তবে অন্যান্য রাজ্য এ রায় মানবে কি না তা অনিশ্চিত। ফলে করদাতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি থেকে যাচ্ছে। অনেক সময় করদাতারা এই বিষয়ে জিএসটি কাউন্সিলে আবেদন করতে বা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হচ্ছেন।

জিএসটি চারটি করস্ল্যাবে বিভক্ত এবং অনেক ছাড় ও বিশেষ বিধান রয়েছে। এর ফলে নানা লেনদেন ও ব্যাখ্যা সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছে। নোটিশ পে, বাতিলকরণ চার্জ, লিকুইডেটেড ড্যামেজ—এসব বিষয়ে অতীতে সুপ্রিম কোর্ট বা বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে রায় থাকলেও জিএসটি কর্তৃপক্ষ নতুন করে কর দাবি করছে। এতে মামলা বাড়ছে এবং জিএসটির সরলতা নষ্ট হচ্ছে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার নজির করদাতাদের জন্য আশার আলো জুগিয়েছে। যেমন—
Safari Retreats মামলা: ভবন নির্মাণ যদি করযোগ্য পরিষেবা প্রদানের জন্য অপরিহার্য হয়, তবে সেই নির্মাণে আইটিসি পাওয়া যাবে।
Mohit Minerals মামলা: আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে সমুদ্রপথ ভাড়ার ওপর জিএসটি ধার্য করা অসাংবিধানিক।

Advertisements

তবে Northern Operating Systems মামলার রায়কে ঘিরে বিদেশি নাগরিক কর্মরত ভারতীয় সংস্থাগুলিতে নতুন কর দাবি উঠেছে। পাশাপাশি অনলাইন গেমিং খাতে ‘গেম অব স্কিল’ বনাম ‘গেম অব চান্স’ বিতর্ক নতুন জটিলতা তৈরি করেছে।

জিএসটি আইনের অধীনে বিভিন্ন রাজ্যে অগ্রিম রুলিং অথরিটি (AAR) গঠিত হলেও একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসছে। যেমন, Giriraj Renewables Pvt Ltd-এর ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে ভিন্ন করহার নির্ধারিত হয়েছে। এর ফলে বহু-রাজ্যে ব্যবসা করা সংস্থাগুলির জন্য সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। উপরন্তু, কেন্দ্রীয় জিএসটি ট্রাইব্যুনাল না থাকায় করদাতাদের সরাসরি হাইকোর্টে যেতে হচ্ছে, যা মামলার চাপ আরও বাড়াচ্ছে।

জিএসটি কাউন্সিল কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সমন্বয়ের একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে করহার, ছাড় ও নীতি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট Mohit Minerals মামলায় জানিয়েছে যে কাউন্সিলের সুপারিশ বাধ্যতামূলক নয়, এটি কেবল পরামর্শমূলক। তবু বাস্তবে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও একরূপ কর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

গত আট বছরে জিএসটি ভারতীয় করব্যবস্থায় এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে। একাধিক কর মিলে একটি একক কাঠামোয় পরিণত হয়েছে, করদাতাদের জন্য রিটার্ন দাখিল ও পরিশোধ প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে, আর প্রশাসনিক জটিলতা অনেকটা কমেছে। যদিও ব্যাখ্যা ও কারিগরি সমস্যার কারণে এখনো মামলা-মোকদ্দমা বেড়েই চলেছে, তবুও সাম্প্রতিক সংস্কার পরিকল্পনা আশার আলো দেখাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করহার কমানো এবং দুই স্তরের সরল কাঠামো চালু হলে ইনভার্টেড ডিউটি সমস্যা দূর হবে, আইটিসি ব্যবস্থাও আরও কার্যকর হবে। সব মিলিয়ে “এক দেশ – এক কর – এক বাজার” দর্শনের দিকে ভারত আরও এক ধাপ এগোবে।