গণেশ চতুর্থী ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব ২৭ আগস্ট ২০২৫ থেকে শুরু হচ্ছে৷ এই বছর পশ্চিমবঙ্গে পরিবেশবান্ধব (Eco-Friendly Ganesh Idol) উদযাপনের প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে। কলকাতা, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি এবং অন্যান্য জেলায় ভক্তরা পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতার সাথে গণেশ উৎসব পালনের জন্য মাটির গণেশ মূর্তি, বীজযুক্ত মূর্তি এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি মূর্তির দিকে ঝুঁকছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থী উদযাপনের জন্য পরিবেশবান্ধব গণেশ মূর্তি এবং সজ্জার ট্রেন্ডিং আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করব, যা পশ্চিমবঙ্গের ভক্তদের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
পরিবেশবান্ধব গণেশ মূর্তির গুরুত্ব
গণেশ চতুর্থীর ঐতিহ্যবাহী উদযাপনে প্রায়শই প্লাস্টার অফ প্যারিস (PoP) দিয়ে তৈরি মূর্তি ব্যবহৃত হয়, যা জলাশয়ে বিসর্জনের সময় দূষণ ঘটায়। এই মূর্তিগুলি জলে সহজে দ্রবীভূত হয় না এবং এতে ব্যবহৃত রাসায়নিক রং জলজ প্রাণী ও পরিবেশের ক্ষতি করে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে হুগলি নদী এবং অন্যান্য জলাশয়ের দূষণ রোধে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলি পরিবেশবান্ধব মূর্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। শাদু মাটি, লাল মাটি, কাগজের মণ্ড এবং প্রাকৃতিক রং দিয়ে তৈরি মূর্তি পরিবেশের জন্য নিরাপদ এবং সহজে দ্রবীভূত হয়।
২০২৫ সালের ট্রেন্ডিং পরিবেশবান্ধব গণেশ মূর্তির আইডিয়া
নিম্নলিখিত কিছু জনপ্রিয় এবং উদ্ভাবনী পরিবেশবান্ধব মূর্তির ধারণা, যা ২০২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে ট্রেন্ড করছে:
শাদু মাটির গণেশ মূর্তি
বৈশিষ্ট্য: শাদু মাটি (নদীর মাটি) দিয়ে তৈরি এই মূর্তিগুলি ১০০% জৈব-বিঘটনযোগ্য এবং জলে দ্রুত দ্রবীভূত হয়। এগুলি প্রাকৃতিক রং দিয়ে সজ্জিত করা হয়, যা জলজ প্রাণীদের জন্য নিরাপদ। পশ্চিমবঙ্গের কুমোরটুলির মতো এলাকায় দক্ষ কারিগররা এই মূর্তি তৈরি করেন।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: বাড়িতে একটি পরিষ্কার বালতিতে জলে বিসর্জন দিন। দ্রবীভূত মাটি বাগানে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জনপ্রিয়তা: কলকাতা এবং দুর্গাপুরে এই মূর্তিগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়, বিশেষ করে ছোট আকারের (৪-১২ ইঞ্চি) মূর্তি যা বাড়ির পূজার জন্য উপযুক্ত।
উদাহরণ: কুমোরটুলির কারিগররা ২০২৫ সালের জন্য ঐতিহ্যবাহী নকশার পাশাপাশি পাগড়ি গণেশ এবং সিংহাসনে বসা গণেশের মতো আধুনিক ডিজাইন তৈরি করছেন।
বীজযুক্ত (প্লান্টেবল) গণেশ মূর্তি
বৈশিষ্ট্য: এই মূর্তিগুলি মাটি এবং বীজ (যেমন তুলসী, মেথি বা মরিগোল্ড) মিশিয়ে তৈরি করা হয়। বিসর্জনের পর এই মূর্তিগুলি মাটিতে রোপণ করা যায়, যা থেকে গাছ জন্মায়।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: বিসর্জনের জন্য একটি পাত্রে জল দিয়ে মূর্তি দ্রবীভূত করুন এবং অবশিষ্ট মাটি বীজসহ একটি পটে রোপণ করুন।
জনপ্রিয়তা: শিলিগুড়ি এবং কলকাতার শহুরে পরিবারগুলির মধ্যে এই মূর্তি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, কারণ এটি উৎসবের পরে সবুজায়নের একটি সুযোগ দেয়।
উদাহরণ: সাতভিক স্টোরের ‘বাপ্পার ট্রি’ মূর্তি, যা তুলসী বা মরিগোল্ড বীজযুক্ত, ২০২৫ সালে ব্যাপক চাহিদা পাচ্ছে।
খাদ্যযোগ্য গণেশ মূর্তি
বৈশিষ্ট্য: চকোলেট, খোয়া (মাওয়া), শুকনো ফল বা শাকসবজি দিয়ে তৈরি এই মূর্তিগুলি বিসর্জনের পর প্রসাদ হিসেবে খাওয়া যায়। এগুলি সম্পূর্ণ বর্জ্যমুক্ত এবং পরিবেশের জন্য নিরাপদ।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: পূজার পর মূর্তিটি দুধ বা জলে দ্রবীভূত করে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করুন।
জনপ্রিয়তা: কলকাতার স্থানীয় মিষ্টির দোকান এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চকোলেট এবং খোয়ার মূর্তি জনপ্রিয় হচ্ছে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে।
উদাহরণ: মাই পূজা বক্স চকোলেট গণেশ মূর্তি অফার করছে, যা শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় এবং পরিবেশবান্ধব।
ধাতব গণেশ মূর্তি
বৈশিষ্ট্য: পিতল, ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি এই মূর্তিগুলি প্রতি বছর পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এবং বিসর্জনের প্রয়োজন হয় না। এগুলি দীর্ঘমেয়াদী এবং পরিবেশের জন্য নিরাপদ।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: পূজার জন্য উত্তর-পূর্ব দিকে একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মে মূর্তি স্থাপন করুন এবং নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
জনপ্রিয়তা: পশ্চিমবঙ্গের শহুরে পরিবার, বিশেষ করে কলকাতায়, এই মূর্তিগুলি কিনছে, কারণ এটি একটি এককালীন বিনিয়োগ।
উদাহরণ: গিরি ট্রেডিং এজেন্সি এবং সাতভিক স্টোর পিতলের গণেশ মূর্তি অফার করছে, যা ঐতিহ্য এবং স্থায়িত্বের সমন্বয়।
কাগজের মণ্ড বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের মূর্তি
বৈশিষ্ট্য: পুরানো সংবাদপত্র, কার্ডবোর্ড বা কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি এই মূর্তিগুলি হালকা ও পরিবেশবান্ধব। এগুলি বাড়িতে বিসর্জনের জন্য উপযুক্ত।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: জলে দ্রবীভূত করুন বা বাগানে কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করুন।
জনপ্রিয়তা: শিলিগুড়ি এবং হাওড়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সম্প্রদায় এই মূর্তিগুলি তৈরির জন্য কর্মশালা আয়োজন করছে।
উদাহরণ: পটারিডেনের কর্মশালায় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা কাগজের মণ্ড দিয়ে মূর্তি তৈরি শিখছে।
পরিবেশবান্ধব সজ্জার আইডিয়া
মূর্তির পাশাপাশি, গণেশ মণ্ডপের সজ্জাও পরিবেশবান্ধব হওয়া উচিত। এখানে কিছু ট্রেন্ডিং ধারণা:
- ফুলের রাংগোলি: মরিগোল্ড, গোলাপ বা তুলসী পাতা দিয়ে রাংগোলি তৈরি করুন। উৎসবের পর এগুলি কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
- পুনর্ব্যবহারযোগ্য সজ্জা: পুরানো শাড়ি, দুপাট্টা বা কাগজ দিয়ে ব্যাকড্রপ এবং ফিতা তৈরি করুন।
- কাদামাটির দীপ ও সোলার লাইট: প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাদামাটির দীপ এবং সোলার-চালিত LED লাইট ব্যবহার করুন।
ভেষজ উদ্ভিদ: তুলসী, পুদিনা বা মেহেন্দি গাছ দিয়ে মণ্ডপ সাজান, যা পরে ঔষধি বা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়।
পশ্চিমবঙ্গে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ
- কুমোরটুলির ভূমিকা: কলকাতার কুমোরটুলির কারিগররা ২০২৫ সালে শাদু মাটির মূর্তির উৎপাদন বাড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার এবং এনজিওগুলি কারিগরদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
- সরকারি উদ্যোগ: পশ্চিমবঙ্গ সরকার হুগলি নদীতে বিসর্জন নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করছে এবং পরিবেশবান্ধব মূর্তির ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াচ্ছে।
- কর্মশালা ও সচেতনতা: শিলিগুড়ি এবং দুর্গাপুরে স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারগুলি শিশুদের জন্য মাটির মূর্তি তৈরির কর্মশালা আয়োজন করছে।
- অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: সাতভিক স্টোর, মাই পূজা বক্স এবং গিরি ট্রেডিং এজেন্সি পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত ডেলিভারির সাথে পরিবেশবান্ধব মূর্তি অফার করছে।
কীভাবে পরিবেশবান্ধব মূর্তি চিনবেন?
- ওজন: PoP মূর্তি হালকা, যেখানে মাটির মূর্তি তুলনামূলকভাবে ভারী।
- রং: পরিবেশবান্ধব মূর্তিতে প্রাকৃতিক রং ব্যবহৃত হয়, যা চকচকে নয় এবং জলে দ্রবীভূত হয়।
- উপাদান: শাদু মাটি, লাল মাটি, কাগজের মণ্ড বা ধাতু দিয়ে তৈরি মূর্তি বেছে নিন। PoP বা রাসায়নিক রং ব্যবহৃত মূর্তি এড়িয়ে চলুন।
২০২৫ সালের গণেশ চতুর্থী পশ্চিমবঙ্গে পরিবেশবান্ধব উদযাপনের একটি নতুন দিশা নিয়ে এসেছে। শাদু মাটির মূর্তি, বীজযুক্ত গণেশ, খাদ্যযোগ্য মূর্তি, ধাতব মূর্তি এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য সজ্জার মাধ্যমে ভক্তরা ঐতিহ্য ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করছেন। কলকাতা, দুর্গাপুর এবং শিলিগুড়ির মতো শহরগুলিতে কুমোরটুলির কারিগর এবং স্থানীয় উদ্যোগ এই সবুজ বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই উৎসবে পরিবেশবান্ধব মূর্তি ও সজ্জা বেছে নিয়ে গণেশ চতুর্থীকে শুধু ভক্তির নয়, পরিবেশ রক্ষারও একটি উৎসব করে তুলুন।