দীর্ঘ ১৭ বছর পর অবশেষে লাভের মুখ দেখল বিএসএনএল (BSNL)। সরকারি মালিকানাধীন এই টেলিকম সংস্থা বহুদিন ধরেই আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছিল। যদিও ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১.৬৪ লক্ষ কোটি টাকার পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করে, তবুও সংস্থার আয় বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ত্রৈমাসিকে বিএসএনএল ২৬২ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে। সংস্থার আয় বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
এই পুনরুত্থানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার তাদের প্রচেষ্টার কৃতিত্ব দাবি করলেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সাফল্যের পেছনে বিরোধী দলগুলোরও বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলি বিএসএনএল-এর প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সিপিআইএম সহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি জনগণকে বিএসএনএলের সিম ব্যবহারে উৎসাহিত করে। এই সময় থেকেই সংস্থার গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বছরের শেষ দিকে বিএসএনএল লাভের মুখ দেখে।
বিএসএনএল-এর পুনরুজ্জীবন: কেন্দ্র না বিরোধীদের কৃতিত্ব?
বিএসএনএল দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি প্রতিযোগিতার চাপে পিছিয়ে পড়ছিল। রিলায়েন্স জিও এবং এয়ারটেলের মতো বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলোর আধিপত্যের কারণে বিএসএনএল তার বাজার হারাচ্ছিল। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংস্থাটিকে চাঙ্গা করতে বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছিল না।
কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই মাসের পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। সেই সময় বামদলগুলি ব্যাপক প্রচার শুরু করে বিএসএনএল-এর পক্ষে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সরকারি টেলিকম সংস্থার পরিষেবা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। অবিজেপি অন্যান্য দলগুলিও এতে সুর মেলায়।
এই প্রচারের পেছনে রাজনৈতিক কারণও ছিল। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে রিলায়েন্স কর্তা মুকেশ আম্বানির ছেলে অনন্ত আম্বানির বিলাসবহুল বিয়ের কারণে আম্বানিদের পরিবার চরম সমালোচনার মুখে পড়ে। ৫ হাজার কোটির বেশি খরচ করা সেই বিয়ে নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, তখনই রিলায়েন্স জিও ডেটা ও কলচার্জ বাড়িয়ে দেয়।
এরপর বিরোধীরা প্রচার শুরু করে যে, অনন্ত আম্বানির বিয়ের খরচ তুলতেই জিওর মাশুল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় #BoycottJio ট্রেন্ড করতে থাকে এবং বিএসএনএল-এর সিম ব্যবহারের ডাক দেওয়া হয়। ক্রমেই বিএসএনএল নতুন গ্রাহক পেতে শুরু করে এবং বছরের শেষ তিন মাসে তা লাভজনক হয়ে ওঠে।
কেন্দ্রের দাবির পাল্টা সমালোচনা
কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য বিএসএনএল-এর এই সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব নিজেদের দিকেই টেনে নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া এই লাভের তথ্য টুইট করে লেখেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে, বিএসএনএল টেকসই পুনরুদ্ধার ও বৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে।”
কিন্তু বিরোধীরা এই দাবিকে মেনে নিতে নারাজ। সিপিআইএম-এর এক নেতা বলেন, “যদি সরকার সত্যিই বিএসএনএল-এর পুনরুজ্জীবন চেয়ে থাকত, তবে এতদিন ধরে বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বার্থে কাজ করত না। বিএসএনএল-কে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল। জনগণের চাপে সরকার বাধ্য হয়েছে বিএসএনএল-কে বাঁচাতে।”
বিএসএনএল-এর ভবিষ্যৎ কি?
বর্তমানে বিএসএনএল তার ৪জি এবং ৫জি পরিষেবা চালুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যদি জনগণের সমর্থন বজায় থাকে, তাহলে সংস্থাটি ভবিষ্যতে আরও লাভজনক হতে পারে।
তবে এই পুনরুত্থান স্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, বেসরকারি সংস্থাগুলি প্রতিযোগিতার বাজারে নতুন নতুন অফার এনে গ্রাহকদের ফের টানার চেষ্টা করবে। বিএসএনএল যদি যথাযথ পরিকাঠামো উন্নয়ন করতে না পারে, তবে লাভের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হবে।
বিএসএনএল-এর এই নতুন সাফল্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। কেন্দ্র সরকার এর কৃতিত্ব দাবি করলেও, বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা নেহাত কম নয়। বিশেষত বামপন্থী দলগুলোর পরিকল্পিত প্রচারের জেরেই নতুন করে গ্রাহক আকৃষ্ট হয়েছে।
এই সাফল্য সাময়িক, নাকি দীর্ঘমেয়াদি—তা নির্ভর করছে সংস্থার ভবিষ্যৎ কৌশলের ওপর। তবে জনগণের সমর্থন ও সরকারী সহযোগিতা থাকলে বিএসএনএল আবারও ভারতীয় টেলিকম বাজারে শক্ত প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে।