অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এই ঘোষণার পর থেকেই ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্টে আলোচনা চলছে। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর হলো একটি গুণক, যা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি কর্মচারীদের বেতন এবং পেনশন নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। রিপোর্টগুলোতে বলা হচ্ছে, অষ্টম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ থেকে ২.৮৬-এর মধ্যে থাকতে পারে। তবে একটি সাধারণ ভুল ধারণা রয়েছে যে, যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তাহলে বেতন এবং পেনশন সরাসরি এই হারে বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবে, এই ফ্যাক্টর শুধুমাত্র মূল বেতনের (বেসিক পে) ওপর প্রযোজ্য হয়, মোট বেতনের (গ্রস স্যালারি) ওপর নয়। তাই মোট বেতনের ওপর ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর প্রয়োগ করে বৃদ্ধির হিসেব করা ভুল এবং বিভ্রান্তিকর।
অষ্টম বেতন কমিশনের ২.৮৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর কি সত্যিই বেতন বাড়াবে?
অষ্টম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি সত্যিই উল্লেখযোগ্যভাবে বেতন বাড়াবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের বেতন বৃদ্ধির প্রকৃত হিসেব বোঝা দরকার। মোট বেতন গণনা করা হয় মূল বেতনের সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ), গৃহভাড়া ভাতা (এইচআরএ), পরিবহন ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা যোগ করে। ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর কিন্তু শুধু মূল বেতনের ওপর কাজ করে।
Also Read | মিসড ডেডলাইন? ৩১ মার্চের মধ্যে অগ্রিম ট্যাক্স দিন, অতিরিক্ত সুদ এড়ান
উদাহরণস্বরূপ, সপ্তম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭। এর ফলে ২০১৬ সালে মূল বেতন ষষ্ঠ কমিশনের ৭,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮,০০০ টাকা হয়েছিল। তবে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি পে-লেভেলের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়েছিল। লেভেল ১ থেকে ৩-এর কর্মচারীদের জন্য গড়ে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছিল, আর লেভেল ৪ থেকে ১০-এর কর্মচারীরা এর চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলেই বেতন সরাসরি ২.৮৬ গুণ বাড়বে—এই ধারণা সঠিক নয়।
প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি বোঝা
ধরা যাক, একজন কর্মচারীর বর্তমান মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা। যদি অষ্টম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তবে নতুন মূল বেতন হবে ১৮,০০০ × ২.৮৬ = ৫১,৪৮০ টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা (ধরা যাক ৭০% হারে ২০২৬ সালে), গৃহভাড়া ভাতা (মেট্রো শহরে ২৪%) এবং অন্যান্য ভাতা যোগ হবে। সপ্তম কমিশনে ডিএ এবং অন্যান্য ভাতা যোগ হওয়ার পর মোট বেতনের বৃদ্ধি গড়ে ১৪.৩% হয়েছিল। তাই অষ্টম কমিশনে ২.৮৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর হলেও প্রকৃত বৃদ্ধি সম্ভবত ২৫-৩৫% এর মধ্যে থাকবে, যা পে-লেভেল এবং ভাতার ওপর নির্ভর করবে।
ঐতিহাসিক বেতন বৃদ্ধির প্রবণতা
বেতন কমিশনগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের সঙ্গে সরাসরি সমানুপাতিক নয়। নিচে পূর্ববর্তী কমিশনগুলোর তথ্য দেওয়া হলো:
• দ্বিতীয় বেতন কমিশন: ১৪.২%
• তৃতীয় বেতন কমিশন: ২০.৬%
• চতুর্থ বেতন কমিশন: ২৭.৬%
• পঞ্চম বেতন কমিশন: ৩১.০%
• ষষ্ঠ বেতন কমিশন: ৫৪.০% (ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৮৬)
• সপ্তম বেতন কমিশন: ১৪.৩% (ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭)
ষষ্ঠ কমিশনে বৃদ্ধি বেশি হয়েছিল, কিন্তু সপ্তম কমিশনে তা অনেক কমে গিয়েছিল। অষ্টম কমিশনে ২.৮৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর হলে বৃদ্ধি সম্ভবত ২৫-৩৫% এর মধ্যে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অষ্টম বেতন কমিশনের হালনাগাদ
সংসদ সদস্য কঙ্গনা রানাউত এবং সাজদা আহমেদের প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ জানিয়েছেন, “অষ্টম বেতন কমিশনের কার্যবিবরণী (টার্মস অফ রেফারেন্স বা ToR) নিয়ে প্রধান স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কর্মী ও প্রশিক্ষণ বিভাগ এবং বিভিন্ন রাজ্য। অষ্টম কমিশনের প্রভাব মূল্যায়ন করা যাবে কমিশনের সুপারিশ এবং সরকারের গ্রহণযোগ্যতার পর।”
অর্থমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের বেসামরিক কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৬.৫৭ লক্ষ এবং ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেনশনভোগী/পরিবার পেনশনভোগীর সংখ্যা ৩৩.৯১ লক্ষ। প্রতিরক্ষা কর্মী এবং পেনশনভোগীরাও এই কমিশনের সুবিধা পাবেন।
অষ্টম বেতন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে গঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (এনসি-জেসিএম)-এর কর্মচারী পক্ষ প্রস্তাব দিয়েছিল যে, নতুন কমিশনের শর্তে বেতন স্কেল, ভাতা, অন্যান্য সুবিধা এবং পেনশন ও গ্র্যাচুইটির মতো অবসর সুবিধার বিস্তৃত পর্যালোচনা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
সম্ভাব্য প্রভাব ও প্রত্যাশা
যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তবে সর্বনিম্ন মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫১,৪৮০ টাকা হতে পারে। এর সঙ্গে ডিএ (৭০% ধরে ৩৫,৮৩৬ টাকা), এইচআরএ (২৪% ধরে ১২,৩৫৫ টাকা) এবং অন্যান্য ভাতা যোগ হলে মোট বেতন প্রায় ৯৯,৬৭১ টাকা হতে পারে। বর্তমানে সর্বনিম্ন মোট বেতন (৫০% ডিএ সহ) প্রায় ৩৩,০০০ টাকা। তাই প্রকৃত বৃদ্ধি হবে প্রায় ৩০-৩৫%। পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পেনশন ৯,০০০ থেকে বেড়ে ২৫,৭৪০ টাকা হতে পারে।
তবে, যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ হয়, তাহলে মূল বেতন হবে ৩৪,৫৬০ টাকা। ডিএ এবং অন্যান্য ভাতা যোগ করে মোট বেতন প্রায় ৭০,০০০ টাকা হতে পারে, যা ২০-২৫% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এই পার্থক্যের কারণে কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
বেতন বৃদ্ধি কেন্দ্রীয় সরকারের ৩৬.৫৭ লক্ষ কর্মচারী এবং ৩৩.৯১ লক্ষ পেনশনভোগীর জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়াবে এবং অর্থনীতিতে গতি আনতে পারে। তবে, সরকারের ব্যয়ও বাড়বে, যা রাজস্ব ঘাটতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অষ্টম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে বেতন ও পেনশনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হবে, তবে এটি ২.৮৬ গুণ বৃদ্ধি নয়। প্রকৃত বৃদ্ধি ২৫-৩৫% এর মধ্যে থাকতে পারে, যা ডিএ, এইচআরএ এবং অন্যান্য ভাতার ওপর নির্ভর করবে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে কমিশন গঠনের পর সুপারিশ এলে এই বিষয়ে স্পষ্টতা আসবে। কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা এখন এই আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন।