কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। প্রতি দশ বছর অন্তর বেতন কাঠামো, ভাতা এবং পেনশন সংশোধনের জন্য গঠিত এই কমিশনের প্রত্যাশিত ঘোষণা ও বাস্তবায়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা এবং প্রত্যাশা ক্রমশ বাড়ছে। জুন ২০২৫ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই কমিশনের গঠন, বাস্তবায়নের সম্ভাব্য তারিখ এবং এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা ও গঠন
২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে, অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দেয়। এই ঘোষণা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন যে, সপ্তম বেতন কমিশনের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা, এবং অষ্টম বেতন কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ এবং এর কার্যপ্রণালীর শর্তাবলী (Terms of Reference, ToR) এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, কমিশন গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছে, যাতে এর সুপারিশগুলি সময়মতো বাস্তবায়ন করা যায়। তবে, ২০২৫ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে (যা ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ ঘোষিত হয়েছিল) এই কমিশনের জন্য কোনও আর্থিক বরাদ্দের উল্লেখ না থাকায় অনেকে আশঙ্কা করছেন যে বাস্তবায়ন ২০২৬ সালের জানুয়ারির পরেও বিলম্বিত হতে পারে।
বেতন ও পেনশন বৃদ্ধির সম্ভাবনা
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশগুলি প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীকে প্রভাবিত করবে, যার মধ্যে প্রতিরক্ষা কর্মীরাও রয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেতন বৃদ্ধির হার ২০% থেকে ৩৫% পর্যন্ত হতে পারে। এই বৃদ্ধি নির্ভর করবে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর (Fitment Factor) এর ওপর, যা বেতন ও পেনশন গণনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণক। সপ্তম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, যার ফলে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮,০০০ টাকা হয়েছিল।
অষ্টম বেতন কমিশনের জন্য ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২ হয়, তবে সর্বনিম্ন মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩৪,৫৬০ টাকা হতে পারে। আর যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তবে সর্বনিম্ন বেতন ৫১,৪৮০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে। একইভাবে, সর্বনিম্ন পেনশন ৯,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭,২৮০ থেকে ২৫,৭৪০ টাকার মধ্যে হতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি এবং ভাতার সংশোধন
মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance, DA) এবং অন্যান্য ভাতা যেমন গৃহভাড়া ভাতা (HRA) এবং পরিবহন ভাতা (TA) সংশোধন করা হবে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে মহার্ঘ ভাতা ৫০% থেকে বেড়ে ৫৫% হয়েছে। জুলাই ২০২৫-এ এটি ৬৬% পর্যন্ত উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বৃদ্ধি অষ্টম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি মহার্ঘ ভাতাকে মূল বেতনের সঙ্গে একীভূত করার দাবি জানিয়েছে, যাতে নতুন বেতন কাঠামো আরও সরল এবং কার্যকর হয়। এছাড়া, মডিফাইড অ্যাসিওর্ড ক্যারিয়ার প্রোগ্রেশন (MACP) স্কিমে সংস্কারের প্রস্তাবও রয়েছে, যা কর্মচারীদের কর্মজীবনে ন্যূনতম পাঁচটি পদোন্নতির সুযোগ দেবে।
বাস্তবায়নে সম্ভাব্য বিলম্ব
যদিও অষ্টম বেতন কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবায়ন ২০২৬ সালের শেষ বা ২০২৭ সালের শুরু পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে। এর কারণ হিসেবে বাজেটে আর্থিক বরাদ্দের অভাব, কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগে বিলম্ব, এবং সুপারিশ চূড়ান্ত করতে ১৫ থেকে ১৮ মাস সময় লাগার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। তবে, সরকার সাধারণত বিলম্বের ক্ষেত্রে বকেয়া বেতন প্রদান করে, যা কর্মচারীদের আর্থিক ক্ষতি পূরণ করবে।
অর্থনীতিতে প্রভাব
অষ্টম বেতন কমিশন বাস্তবায়নের ফলে সরকারের উপর প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা পড়তে পারে। তবে, এই বেতন বৃদ্ধি কর্মচারীদের হাতে বাড়তি আয় তুলে দেবে, যা ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মধ্য-স্তরের কর্মচারীদের বেতন মাসিক ১৯,০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
কর্মচারীদের প্রত্যাশা
জাতীয় পরামর্শদাতা যন্ত্রপাতি (JCM) এর স্টাফ সাইড ইতিমধ্যে তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যেখানে বেতন কাঠামোর সরলীকরণ এবং নিম্ন-স্তরের বেতন স্কেল (লেভেল ১-৬) একীভূত করার দাবি রয়েছে। শিব গোপাল মিশ্রের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি জুন ২০২৫-এ বৈঠক করে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে।
অষ্টম বেতন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা, তবে বাস্তবায়নের সময়সীমা এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কর্মচারীদের উচিত সরকারি ঘোষণার দিকে নজর রাখা এবং আর্থিক পরিকল্পনা সেই অনুযায়ী করা। এই কমিশন শুধুমাত্র কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে না, বরং অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।