ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে পশ্চিমবঙ্গ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে সবজি উৎপাদনে (Vegetable Production)। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (তৃতীয় উন্নত আনুমানিক তথ্যের ভিত্তিতে) পশ্চিমবঙ্গ সবজি উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, যার অংশ ১৪.১৮ শতাংশ। উত্তর প্রদেশের ১৬.৬৫ শতাংশের পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদানকারী রাজ্য হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (MoA&FW) তথ্য এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে, যা রাজ্যের কৃষি অর্থনীতির জন্য একটি গর্বের বিষয়।
Also Read | বাংলার কৃষকদের জন্য মোবাইল ভ্যান মার্কেট! গ্রাম থেকে শহরের ক্রেতাদের সংযোগ
বিভিন্ন অঞ্চলের অবদান
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে সবজি উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে নদিয়া, মুরশিদাবাদ ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলাগুলো এই ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। গঙ্গা নদীর আলুভূমি এবং বছরের প্রায় সারা সময় উপযোগী আবহাওয়া সবজি চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে কৃষি ও কৃষক কল্যাণ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে সবজি উৎপাদন ২৯,২২০.৭২৪ টন হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম হলেও এখনো উল্লেখযোগ্য। এই উৎপাদন ক্ষমতা ছোট ও মাঝারি কৃষকদের জীবিকা নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করছে। বিদ্যানন্দন চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (BCKV) গবেষণা অনুসারে, আলু বাদে সবজি চাষের জন্য ব্যবহৃত জমির প্রায় ১৪ শতাংশ এলাকা রয়েছে, যা দেশে সর্বোচ্চ।
কৃষি অর্থনীতিতে সবজির ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে কৃষি এখনো একটি প্রধান খাত, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজ্যের মোট গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (GSDP)-এর ১৭.৭৭ শতাংশ অবদান রাখে। এই অঞ্চলে কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবজি উৎপাদন নিশ্চিত করা রাজ্যের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে। সবজি চাষে বৈচিত্র্য এবং বাজারভিত্তিক পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে রাজ্যে এখন “বাজারভিত্তিক চাষ” এর দিকে এগোয়া শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার সবজির জন্য একটি অগ্রাণী এলাকা (AEZ) গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে, যা নদিয়া, মুরশিদাবাদ ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলাকে কেন্দ্র করে কার্যকর হবে।
Also Read | শাকসবজি চাষে লাভের হিসাব! বাংলার কৃষকরা বিঘা প্রতি কত আয় করতে পারেন
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
তবে এই সফলতার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সবজি সহজে খারাপ হওয়ার কারণে সঠিক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অভাব এখনো একটি বড় সমস্যা। গত বছরের তুলনায় উৎপাদনের হ্রাস এই বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে। তাছাড়া, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যে বাধা ও বাজারে দামের অস্থিরতা কৃষকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার একসঙ্গে কাজ করে এই সমস্যাগুলোর সমাধানে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ঠান্ডা গুদাম ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
রপ্তানি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
ভারতের সবজি রপ্তানি বাজার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১.৮১৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে (APEDA তথ্য অনুযায়ী), এবং পশ্চিমবঙ্গ এই খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। পটল, কচু, ও লাউের মতো স্থানীয় সবজি বিদেশে চাহিদা বাড়ছে, যা রাজ্যের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া, আদিবাসী কৃষকদের জন্য বিদ্যানন্দন চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে চলমান প্রকল্পগুলো সবজি চাষে নতুন মাত্রা যোগ করছে। বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় ৪০০-এরও বেশি আদিবাসী কৃষক এই উদ্যোগে জড়িত হয়ে উৎপাদন বাড়াচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার একসঙ্গে কাজ করে সবজি উৎপাদনে আরও উন্নতি আনার পরিকল্পনা করছে। আধুনিক প্রযুক্তি, জৈব কৃষি এবং সারা বছর চাষের জন্য নতুন প্রকল্প চালু করা হবে। এর ফলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং রাজ্যের অর্থনীতিতে আরও ইতিবাচক অবদান রাখা সম্ভব হবে। পশ্চিমবঙ্গের এই কৃষি সাফল্য ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।