কলকাতার বাজারে ব্যাপক চাহিদার ৫ সবজি, কৃষকদের জন্য বড় লাভের সুযোগ

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বাজারগুলো (Kolkata Markets) সবজির চাহিদার জন্য সর্বদা প্রাণবন্ত। পোস্তা বাজার, কোলে মার্কেট, গড়িয়াহাট এবং মানিকতলার মতো পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে প্রতিদিন বিপুল…

Vegetables in Kolkata Markets for Profitable Farming

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বাজারগুলো (Kolkata Markets) সবজির চাহিদার জন্য সর্বদা প্রাণবন্ত। পোস্তা বাজার, কোলে মার্কেট, গড়িয়াহাট এবং মানিকতলার মতো পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ সবজি কেনাবেচা হয়। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন, সরবরাহ শৃঙ্খলার সমস্যা এবং মৌসুমি ফসলের উৎপাদন হ্রাসের কারণে কিছু নির্দিষ্ট সবজির দাম আকাশছোঁয়া। এই পরিস্থিতি কৃষকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে, বিশেষ করে যেসব সবজির বাজারে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কলকাতার বাজারে বর্তমানে পাঁচটি সবজি—টমেটো, সবুজ মরিচ, বেগুন, ফুলকপি এবং ঝিঙে—উচ্চ চাহিদার কারণে কৃষকদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই সবজিগুলোর চাহিদা, দাম এবং কৃষকদের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছি।

১. টমেটো: বাজারের রাজা
টমেটো কলকাতার বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদার সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০২৪ সালের জুন মাসে টমেটোর দাম খুচরা বাজারে কেজি প্রতি ৮০-১০০ টাকা ছুঁয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ টমেটো বেঙ্গালুরু, হিমাচল প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে আমদানি করা হয়। তবে, তাপপ্রবাহ এবং ভারী বৃষ্টির কারণে এই অঞ্চলগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে, কলকাতার পাইকারি বাজারে টমেটোর দাম কেজি প্রতি ৬০-৭০ টাকা, এবং খুচরা বাজারে ১০০ টাকার বেশি। কৃষকরা যদি টমেটো চাষে মনোযোগ দেন, বিশেষ করে হাইব্রিড জাত যেমন ‘অর্কা রক্ষিত’ বা ‘পুসা রুবি’, তবে তারা উচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারেন। টমেটো চাষে প্রতি হেক্টরে ১.৫-২ লাখ টাকা লাভ সম্ভব, যদি সঠিক বাজার সংযোগ এবং সেচ ব্যবস্থা থাকে।

   

২. সবুজ মরিচ: রান্নাঘরের অপরিহার্য উপাদান
সবুজ মরিচ কলকাতার প্রতিটি রান্নাঘরে অপরিহার্য। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার বাজারে সবুজ মরিচের দাম কেজি প্রতি ২৫০-৩০০ টাকায় পৌঁছেছে, যা পূজার মরসুমের আগে অভূতপূর্ব। বর্ষার শেষে ভারী বৃষ্টি এবং বন্যার কারণে স্থানীয় ফসলের ক্ষতি হয়েছে, যার ফলে সরবরাহ কমে গেছে। কোলে মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী গোপাল সোনকার জানিয়েছেন, “স্থানীয় ফসলের ক্ষতির কারণে আমরা অন্য রাজ্য থেকে সবুজ মরিচ আমদানি করছি, কিন্তু পরিমাণ কম এবং নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বেশি।” কৃষকরা যদি সবুজ মরিচের চাষে মনোযোগ দেন, বিশেষ করে দ্রুত ফলনশীল জাত যেমন ‘ক্যালিফোর্নিয়া ওয়ান্ডার’, তবে তারা প্রতি হেক্টরে ১-১.৫ লাখ টাকা লাভ করতে পারেন।

৩. বেগুন: চাহিদা এবং দামের শীর্ষে
বেগুন, যা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘বাইগান’ বা ‘এগপ্ল্যান্ট’ নামে পরিচিত, কলকাতার বাজারে উচ্চ চাহিদার আরেকটি সবজি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বেগুনের দাম খুচরা বাজারে ১১০-১৪০ টাকা প্রতি কেজি পৌঁছেছে। তাপপ্রবাহ এবং বৃষ্টির কারণে স্থানীয় উৎপাদন কমে যাওয়ায় বেগুনের দাম বেড়েছে। সুফল বাংলার মতো সরকারি উদ্যোগে বেগুন ১০২ টাকা প্রতি কেজিতে বিক্রি হলেও, খুচরা বাজারে দাম অনেক বেশি। বেগুন চাষে কম জল এবং কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন, যা এটিকে কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল করে তুলেছে। জৈব কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে বেগুন চাষ করলে কৃষকরা শহরের স্বাস্থ্য সচেতন গ্রাহকদের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করতে পারেন।

৪. ফুলকপি: শীতের জনপ্রিয় সবজি
ফুলকপি কলকাতার শীতকালীন বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফুলকপির দাম খুচরা বাজারে প্রতি পিস ৪০ টাকা পৌঁছেছে, যা সাধারণত শীতকালে আরও সাশ্রয়ী থাকে। সাপ্লাই চেইনের সমস্যা এবং স্থানীয় ফসলের ক্ষতির কারণে এই দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষকরা যদি শীতের মরসুমে ফুলকপি চাষে মনোযোগ দেন, তবে তারা উচ্চ চাহিদার সুযোগ নিতে পারেন। হাইব্রিড জাত যেমন ‘পুসা শুভ্রা’ বা ‘পুসা স্নোবল’ বেছে নিলে ফলন বাড়ানো সম্ভব, এবং প্রতি হেক্টরে ৮০,০০০-১ লাখ টাকা লাভ অর্জন করা যায়।

Advertisements

৫. ঝিঙে: গ্রীষ্মকালীন চাহিদার শীর্ষে
ঝিঙে বা রিজ গোর্ড কলকাতার গ্রীষ্মকালীন এবং বর্ষাকালীন বাজারে ব্যাপক চাহিদার একটি সবজি। ২০২৪ সালের জুন মাসে ঝিঙের দাম কেজি প্রতি ৮০ টাকায় পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ঝিঙে চাষে কম খরচ এবং দ্রুত ফলনের কারণে এটি কৃষকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প। এই সবজি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কৃষকরা এটি চাষ করে থাকেন। জৈব পদ্ধতিতে ঝিঙে চাষ করলে কৃষকরা গড়িয়াহাট এবং নিউ মার্কেটের মতো বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করতে পারেন।

কৃষকদের জন্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ
এই পাঁচটি সবজির উচ্চ চাহিদা কৃষকদের জন্য বড় লাভের সুযোগ তৈরি করেছে। তবে, চ্যালেঞ্জও কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, তাপপ্রবাহ, এবং অতিবৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষতি একটি বড় সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় ডানার কারণে দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা সবজির দাম আরও বাড়িয়েছে। এছাড়া, পরিবহন খরচ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষকরা প্রায়ই তাঁদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “সুফল বাংলার মাধ্যমে আমরা কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছি, যাতে তারা ভালো দাম পান।” সুফল বাংলার মতো উদ্যোগে টমেটো ৬৫ টাকা এবং বেগুন ১০২ টাকা প্রতি কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা খুচরা বাজারের তুলনায় ১০-২০% কম।

কলকাতার বাজারে টমেটো, সবুজ মরিচ, বেগুন, ফুলকপি এবং ঝিঙের মতো সবজির উচ্চ চাহিদা কৃষকদের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। জৈব কৃষি, হাইব্রিড বীজ এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষকরা এই চাহিদার সুবিধা নিতে পারেন। তবে, সরকারি সহায়তা, সঠিক সেচ ব্যবস্থা এবং বাজার সংযোগ এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা যদি এই সবজিগুলোর চাষে মনোযোগ দেন, তবে তারা শুধু নিজেদের আর্থিক স্থিতিশীলতাই নিশ্চিত করবেন না, বরং কলকাতার খাদ্য নিরাপত্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।