কীভাবে কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা ইউটিউব ও ফেসবুকে কৃষকদের শিক্ষা দিচ্ছেন

বর্তমান ডিজিটাল যুগে, কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লব ঘটছে, এবং এই বিপ্লবের মূল কারিগর হলেন কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা (Agri-Influencers)। ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এখন…

How Agri-Influencers Are Revolutionizing Farming Education on YouTube and Facebook

বর্তমান ডিজিটাল যুগে, কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লব ঘটছে, এবং এই বিপ্লবের মূল কারিগর হলেন কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা (Agri-Influencers)। ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এখন কৃষকদের জন্য শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা, যারা একসময় ঐতিহ্যগত পদ্ধতির উপর নির্ভর করতেন, এখন ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, জৈব চাষ, এবং বাজার কৌশল সম্পর্কে শিখছেন। ২০২৫ সালে, এই কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য জ্ঞানের একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন, যা কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করছে। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কীভাবে ইউটিউব এবং ফেসবুকের মাধ্যমে কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা কৃষকদের শিক্ষিত করছেন এবং এর প্রভাব কী।

কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সারদের উত্থান
কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা হলেন এমন কৃষক বা কৃষি বিশেষজ্ঞ, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, এবং কৌশল শেয়ার করেন। ভারতে, যেখানে কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এই ইনফ্লুয়েন্সাররা কৃষকদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হয়ে উঠেছেন। ইউটিউব চ্যানেল যেমন ‘ইন্ডিয়ান ফার্মার’, ‘ফার্মিং লিডার’, এবং ‘হ্যালো কিষাণ’ এবং ফেসবুক পেজ যেমন ‘মাই কিষাণ দোস্ত’ এখন লক্ষ লক্ষ কৃষকের কাছে জনপ্রিয়। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে ইনফ্লুয়েন্সাররা জৈব চাষ, গবাদি পশু পালন, মাশরুম চাষ, মৎস্য চাষ, এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে ভিডিও এবং পোস্ট শেয়ার করেন। উদাহরণস্বরূপ, মহারাষ্ট্রের আকাশ এবং সন্তোষ জাধবের ‘ইন্ডিয়ান ফার্মার’ চ্যানেলটি ১৮.২ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের সাথে ভারতের কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

   

ইউটিউবের ভূমিকা
ইউটিউব কৃষকদের জন্য একটি শক্তিশালী শিক্ষণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এই প্ল্যাটফর্মে কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা বিস্তারিত ভিডিওর মাধ্যমে কৃষি কৌশল, নতুন যন্ত্রপাতি, এবং ফসলের বাজার মূল্য সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপ, হরিয়ানার দর্শন সিংয়ের ‘ফার্মিং লিডার’ চ্যানেলটি জৈব চাষ, গবাদি পশু পালন, এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে ৪৭০টিরও বেশি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যা ৩৪ লক্ষ সাবস্ক্রাইবারের কাছে পৌঁছেছে। এই ভিডিওগুলোতে কৃষকরা শিখতে পারেন কীভাবে সাশ্রয়ী উপায়ে কীটনাশক স্প্রে করতে হয় বা কীভাবে ফসলের ফলন বাড়ানো যায়।

ইউটিউবের ভিডিওগুলোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এগুলো দৃশ্যমান এবং সহজে বোধগম্য। কৃষকরা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানই পান না, বরং ব্যবহারিক প্রয়োগও দেখতে পান। উদাহরণস্বরূপ, ‘ভিডিও ভান্ডার’ নামে একটি চ্যানেল ট্রাক্টর পর্যালোচনা, নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি, এবং তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত ভিডিও প্রকাশ করে, যা কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করে। এছাড়াও, এই চ্যানেলগুলোতে কৃষকদের সাফল্যের গল্প শেয়ার করা হয়, যা অন্য কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে।

ফেসবুকের প্রভাব
ফেসবুক ভারতের গ্রামীণ কৃষকদের কাছে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম। এখানে কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের ইউটিউব ভিডিওর লিঙ্ক শেয়ার করেন, সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ) করেন, এবং কৃষকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন। ফেসবুক গ্রুপ এবং পেজগুলো, যেমন ‘ইন্ডিয়ান ফার্মার’ বা ‘মাই কিষাণ দোস্ত’, কৃষকদের একটি সম্প্রদায় গড়ে তুলেছে, যেখানে তারা প্রশ্ন করতে, উত্তর পেতে এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যশ জাটের ‘মাই কিষাণ দোস্ত’ পেজটি ১০ লক্ষেরও বেশি সাবস্ক্রাইবারের কাছে পৌঁছেছে, যেখানে তিনি কৃষি যন্ত্রপাতি, জৈব সার, এবং সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করেন।

How Agri-Influencers Are Revolutionizing Farming Education on YouTube and Facebook
How Agri-Influencers Are Revolutionizing Farming Education on YouTube and Facebook

ফেসবুকের লাইভ সেশনগুলো কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এই সেশনগুলোতে ইনফ্লুয়েন্সাররা কৃষকদের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন এবং ব্যবহারিক সমাধান প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপ, রবিন ত্যাগীর ‘হ্যালো কিষাণ’ পেজটি কৃষকদের সাফল্যের গল্প এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে নিয়মিত পোস্ট করে, যা কৃষকদের মধ্যে আধুনিক কৃষির প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। এছাড়াও, ফেসবুকের মাধ্যমে কৃষকরা স্থানীয় বাজারের মূল্য, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, এবং সরকারি ভর্তুকি সম্পর্কে তথ্য পান।

Advertisements

কৃষকদের জন্য সুবিধা
কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সারদের শিক্ষার মাধ্যমে কৃষকরা বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন। প্রথমত, তারা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারছেন, যেমন ড্রিপ সেচ, হাই-টেক ট্রাক্টর, এবং জৈব সারের ব্যবহার। দ্বিতীয়ত, এই প্ল্যাটফর্মগুলো কৃষকদের একটি সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত করে, যেখানে তারা একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারেন। তৃতীয়ত, ইনফ্লুয়েন্সাররা কৃষকদের সরকারি প্রকল্প, ভর্তুকি, এবং বাজার সংযোগ সম্পর্কে সচেতন করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘ইন্ডিয়ান ফার্মার’ চ্যানেলটি কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী ‘জুগাড়’ সমাধান শেয়ার করে, যা তাদের খরচ কমাতে সাহায্য করে।

এছাড়াও, এই ইনফ্লুয়েন্সাররা কৃষকদের মধ্যে টেকসই কৃষির প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছে। জৈব চাষ, পরিবেশবান্ধব কীটনাশক, এবং জল সংরক্ষণের কৌশল সম্পর্কে শিক্ষা কৃষকদের কার্বন পদচিহ্ন কমাতে এবং ফলন বাড়াতে সাহায্য করছে। উদাহরণস্বরূপ, রবি ত্যাগীর ‘রাভিজোন ফার্মিং লিডার’ চ্যানেলটি কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষিত করে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
তবে, কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সারদের মুখোমুখি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ এবং স্মার্টফোনের প্রাপ্যতা এখনও সীমিত। দ্বিতীয়ত, কিছু কৃষকের মধ্যে ডিজিটাল শিক্ষার প্রতি সচেতনতার অভাব রয়েছে। তৃতীয়ত, ভুয়া তথ্য বা অবাস্তব পরামর্শ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকার এবং কৃষি সংস্থাগুলো ডিজিটাল শিক্ষা প্রচার এবং ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম কৃষকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত করতে সাহায্য করছে৷

ইউটিউব এবং ফেসবুকের মাধ্যমে কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সাররা ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। তারা আধুনিক প্রযুক্তি, টেকসই কৃষি, এবং বাজার কৌশল সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছেন, যা কৃষকদের উৎপাদনশীলতা এবং আয় বাড়াতে সাহায্য করছে। তবে, এই প্রক্রিয়ার সফলতার জন্য গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ উন্নত করা, ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো, এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ২০২৫ সালে, কৃষি-ইনফ্লুয়েন্সারদের এই ভূমিকা ভারতের কৃষি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা যায়।