পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল। তবে, গত কয়েক দশকে গ্রাম থেকে শহরে ক্রমবর্ধমান মাইগ্রেশনের ফলে কৃষিতে শ্রমিক সংকট (Farm Labor Shortage ) একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকা থেকে শ্রমিকরা শহরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন উন্নত জীবিকা, উচ্চ মজুরি এবং আধুনিক জীবনযাত্রার আশায়। এই মাইগ্রেশনের ফলে কৃষি কাজে শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে, যা ফসল উৎপাদন, কৃষকদের আয় এবং রাজ্যের খাদ্য নিরাপত্তার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই নিবন্ধে আমরা পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে শ্রমিক সংকট, গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশনের কারণ এবং এর সমাধানে সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলি বিশ্লেষণ করব।
শ্রমিক সংকটের প্রকৃতি
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি কাজ, বিশেষ করে ধান, পাট, আলু এবং শাকসবজি চাষে, শ্রমিকদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বীজ বপন, চাষ, কীটনাশক প্রয়োগ, ফসল কাটা এবং পরিবহনের মতো কাজগুলি শ্রমনির্ভর। তবে, গ্রামীণ শ্রমিকরা ক্রমশ শহরের নির্মাণ, পরিবহন, এবং পরিষেবা খাতে কাজের জন্য চলে যাচ্ছেন। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকা থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০-১৫% শ্রমিক শহরে মাইগ্রেশন করছেন। এর ফলে কৃষি কাজে শ্রমিকের ঘাটতি ৩০-৪০% পর্যন্ত বেড়েছে, বিশেষ করে বর্ধমান, হুগলি, এবং নদিয়ার মতো কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে।
এই সংকটের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ফসল কাটার মরসুমে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩-২৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকায় ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক না পাওয়ায় ফসল মাঠে পড়ে নষ্ট হয়েছে। এই পরিস্থিতি কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং ফসল উৎপাদনের খরচ বাড়িয়েছে।
গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশনের কারণ
গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশনের পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:
- নিম্ন মজুরি: কৃষি শ্রমিকদের মজুরি শহরের তুলনায় অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের গড় দৈনিক মজুরি ২৫০-৩৫০ টাকা, যেখানে শহরে নির্মাণ বা অন্যান্য খাতে দৈনিক ৫০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় সম্ভব।
- অনিয়মিত কাজ: কৃষি কাজ মৌসুমী এবং বছরের মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয়। অন্যদিকে, শহরে কাজের ধারাবাহিকতা বেশি।
- আধুনিক জীবনযাত্রার আকর্ষণ: তরুণ শ্রমিকরা শহরের জীবনযাত্রা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিনোদনের সুযোগের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন।
- কৃষির অনিশ্চয়তা: জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা এবং বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষি কাজে ঝুঁকি বেড়েছে, যা শ্রমিকদের শহরে মাইগ্রেশনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
- শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: গ্রামীণ তরুণরা শিক্ষা এবং দক্ষতা অর্জনের পর শহরে উন্নত কাজের সুযোগ খুঁজছেন।
কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব
শ্রমিক সংকটের ফলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে বেশ কয়েকটি সমস্যা দেখা দিয়েছে:
- ফসল উৎপাদন হ্রাস: শ্রমিকের অভাবে সময়মতো বীজ বপন, ফসল কাটা এবং পরিচর্যা সম্ভব হচ্ছে না, যার ফলে ফলন কমে যাচ্ছে। ২০২২-২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে ধান উৎপাদন প্রায় ৫% কমে গিয়েছিল শ্রমিক সংকটের কারণে।
- খরচ বৃদ্ধি: শ্রমিকের অভাবে কৃষকরা বেশি মজুরি দিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অনেক কৃষক এখন যান্ত্রিকীকরণের দিকে ঝুঁকছেন, কিন্তু ছোট জমির মালিকদের জন্য এটি ব্যয়বহুল।
- ফসলের গুণগত মান হ্রাস: শ্রমিকের অভাবে ফসলের যথাযথ পরিচর্যা না হওয়ায় ফসলের গুণগত মান কমছে, যা বাজারে কম দাম পাওয়ার কারণ হচ্ছে।
- খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি: পশ্চিমবঙ্গ ভারতের ধান উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। শ্রমিক সংকটের ফলে উৎপাদন হ্রাস খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সমাধানের পথ
শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিছু সম্ভাব্য সমাধান হলো:
- কৃষি শ্রমিকদের জন্য উন্নত মজুরি: কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রদান শ্রমিকদের গ্রামে থাকতে উৎসাহিত করবে।
- যান্ত্রিকীকরণের প্রচার: ছোট কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি এবং ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি কাজে যান্ত্রিকীকরণ বাড়ানো যেতে পারে।
- প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন: গ্রামীণ শ্রমিকদের কৃষি-সংশ্লিষ্ট দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের আয় বাড়ানো যেতে পারে।
- গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন: গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করলে শ্রমিকরা শহরে মাইগ্রেশনের পরিবর্তে গ্রামে থাকতে উৎসাহিত হবে।
- কৃষি সমবায় গঠন: কৃষক এবং শ্রমিকদের সমবায় গঠনের মাধ্যমে শ্রমিক সংকট মোকাবিলা এবং সম্পদ ভাগাভাগি করা সম্ভব।
কৃষক সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য শ্রমিক সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকরা, যারা জমির মালিকানার পরিমাণ কম এবং যান্ত্রিকীকরণের জন্য পর্যাপ্ত মূলধন নেই, এই সংকটের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শ্রমিকের অভাবে তারা ফসলের যথাযথ পরিচর্যা করতে পারছেন না, যা তাদের আয় এবং জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও, শ্রমিক সংকটের ফলে কৃষি কাজের সময়সূচীতে বিলম্ব হচ্ছে, যা ফসলের গুণগত মান এবং বাজার মূল্যের উপর প্রভাব ফেলছে।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে শ্রমিক সংকট একটি জটিল সমস্যা, যা গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশনের ফলে আরও তীব্র হয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার, কৃষি বিভাগ এবং সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কৃষি শ্রমিকদের জন্য উন্নত মজুরি, যান্ত্রিকীকরণ, এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। যদি এই পদক্ষেপগুলি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাত এবং খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।