বরাক উপত্যকায় কয়েকদিন

২০১৮ সালে আমি সাহিত্য আকাদেমির পক্ষ থেকে ট্রাভেল গ্র্যান্ট পেয়েছিলাম। সে বছর জুলাই মাসে একটি কবিতাপাঠের পাঠের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম কলকাতার সাহিত্য আকাদেমি ভবনে। সেদিনই আমি…

বরাক উপত্যকায় কয়েকদিন
বরাক উপত্যকায় কয়েকদিন
অরুণাভ রাহারায়

২০১৮ সালে আমি সাহিত্য আকাদেমির পক্ষ থেকে ট্রাভেল গ্র্যান্ট পেয়েছিলাম। সে বছর জুলাই মাসে একটি কবিতাপাঠের পাঠের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম কলকাতার সাহিত্য আকাদেমি ভবনে। সেদিনই আমি জানতে পারি ট্রাভেল গ্র্যান্ট পেতে চলেছি। জানা মাত্রই অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল আমার। সেদিন আমার সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুও ছিল। আমরা সবাই মিলে এর আনন্দ উদযাপন করেছিলাম।

এই গ্র্যান্ট পেলে সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয়ে দেশের অন্য একটি রাজ্যে যেতে হয়। আমি আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য অসমকে নির্বাচন করেছিলাম। আমার পৈত্রিক বাড়ি আলিপুরদুয়ারে। আর অসমে ঢোকার রাস্তাই হল এই শহর। ছোটবেলা থেকে নানা ভাবে এই রাজ্য সম্পর্কে জেনে এসেছি। পড়েছি অসমীয়া ভাষার কবিতাও। একবার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আলিপুরদুয়ারে এসেছিলেন অসমের বিখ্যাত কবি নীলমণি ফুকন। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন আমার বাবাও। সেবার নীলমণি ফুকনকে খুব কাছ থেকে দেখা সুযোগ পেয়েছিলাম ওই ছোটবেলায়।

ট্রাভেল গ্র্যান্ট পেয়ে আমি গিয়েছিলাম অসমের বরাক উপত্যকায়, শিলচরে। এই শহরের প্রতি আমার ভালবাসার টান। আগেও নানা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। তবে ট্রাভেল গ্রান্ট পেয়ে শিলচরে যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। বেশ কয়েকদিন ছিলাম। দেখা হয়েছিল কিছু গুণী মানুষের সঙ্গে। মনে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী কাছার ক্লাবের কথা। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় সেখানে যেতাম। এখানে এক সময় পোলো খেলা হত। পাশেই ছিল অজন্তা হোটেল। যেখানে আমি উঠেছিলাম।

শিলচরে পৌঁছনোর পরদিন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তার সান্নিধ্য পাওয়া এক বিরল ব্যাপার। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর লেখা ‘কবিতার রূপান্তর’ বইটি বহুবার পড়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি। অনেকজন কবির কবিতাকে চিনতে পারি এই বইটি পড়ে। তাঁর সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিলাম ফোনে। তিনি আমাকে সময় দিয়েছেন। তাঁর মুখোমুখি বসে সাহিত্যের নানা বিষয়ে আলোচনা করি। আমাদের আলোচনার ঘুরে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধের বিশ্লেষণ করেন আমার সামনে।

এ কথা বলতেই হয়ে, তপোধীর বাবুর সঙ্গ পেয়ে আমি সেদিন ঋদ্ধ হয়েছি। তাঁর সারা বড়ি জুড়ে বই আর বই। দেওয়ালে নানা ছবি টাঙানো। একটি ছবিতে দেখলাম তিনি প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির হাতে ডিলিট তুলে দিচ্ছে। ছবিটি প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আমার প্রিয় খেলোয়াড়। আমি যখন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলাম সেই সময় তাকে ডিলিট দিই। তপোধীর ভট্টাচার্য একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। অনেকে তাকে শুধু প্রাবন্ধিক হিসেবেই চেনেন। কিন্তু তিনি একজন কবি। তাঁর একাধিক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিরা আমার খুব ভাল লাগে। কোচবিহার থেকে প্রকাশিত ‘তমসুক’ পত্রিকা তপোধীর ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তাকে জানার জন্য এটি একটি ভাল বই।

Advertisements

এরপর শিলচর শহরে আমি কবিতার অনুষ্ঠানে অংশ নিই। সেখানে আরও কয়েকজন স্থানীয় কবির সঙ্গে আমার দেখা হয়। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল অধ্যাপক অর্জুন চৌধুরীর উদ্যোগে। সেখানে এসেছিলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি অমিতাভ দেব চৌধুরী। তিনিও সেদিন অনেক কবিতা শুনিয়েছিলেন তাঁর বই থেকে। দেখা হয়েছিল তরুণ কবি শতদল আচার্যের সঙ্গে। তিনি কর্মসূত্রে শিলচরে অবস্থিত অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত।

এরপর দিন আমার কবিতা পাঠ ছিল অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। এই বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সেখানে আমার কবিতা শুনতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রছাত্রীরা। আমি সেদিন আমার নতুন কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে একাধিক কবিতা পাঠ করেছিলাম। পড়ুয়াদের মুখোমুখি বসে কবিতা পড়ার আনন্দ আজও ভুলতে পারি না। ২০১৮ সালে আমি যখন অসমে গিয়েছিলাম তখন NRC-র কারণে উত্তাল সারা রাজ্য। শিলচর থেকে আমার যাওয়ার কথা ছিল গুয়াহাটিতে। কিন্তু সেখানে তখন ধর্মঘট চলছিল। তাই আমি প্ল্যান পালটে ফিরে আসি কলকাতায়।