ভারত-মার্কিন বাণিজ্য আলোচনায় টানাপোড়েন, শুল্ক ইস্যুতে জয়শঙ্করের সাফ বার্তা

অর্থনৈতিক টাইমস ওয়ার্ল্ড লিডারস ফোরাম ২০২৫-এ বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর সরাসরি মন্তব্য করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্বাভাবিক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। তিনি বলেন,…

jaishankar about nuclear threat

অর্থনৈতিক টাইমস ওয়ার্ল্ড লিডারস ফোরাম ২০২৫-এ বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর সরাসরি মন্তব্য করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্বাভাবিক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। তিনি বলেন, এর আগে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এতটা প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা করেননি।
জয়শঙ্করের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি শুধু ভারতের ক্ষেত্রে নয়, গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রেই এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।

ফোরামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জয়শঙ্কর বলেন—
“আমরা আগে কখনও এমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখিনি, যিনি এত প্রকাশ্যে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন। এটি শুধু ভারতের জন্য নয়, বৈশ্বিক কূটনীতির জন্যও এক বড় পরিবর্তন।”

   

তিনি আরও যোগ করেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দুনিয়ার সঙ্গে আচরণ করার ধরণ— এমনকি তাঁর নিজের দেশের ভেতরেও— প্রচলিত বা ঐতিহ্যগত পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই প্রকাশ্য পদ্ধতি কেবল পররাষ্ট্রনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই ভিন্নতা এনে দিয়েছে।”

সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের হঠাৎ ঘোষণা অনুযায়ী, ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপকে জয়শঙ্কর আখ্যা দিলেন “হঠাৎ সিদ্ধান্ত” হিসেবে, যেখানে পূর্ব আলোচনা বা পরামর্শের কোনও সুযোগই ছিল না।

তিনি বলেন, “শুল্ককে ট্রাম্প কেবল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নয়, অ-বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, এর অনেক কিছুই সরাসরি জনসমক্ষে ঘোষণা করা হয়। অনেক সময় প্রথম ঘোষণা জনসমক্ষে হয়, যা কূটনীতির ক্ষেত্রে একেবারেই অস্বাভাবিক।”

জয়শঙ্কর স্পষ্ট করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সংজ্ঞায়িত করছে—

১. বাণিজ্যিক আলোচনা
“আলোচনা এখনও চলছে। তবে আমাদেরও কিছু ‘রেড লাইন’ আছে। ভারতীয় কৃষক ও ক্ষুদ্র উৎপাদকদের স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস হবে না,” জয়শঙ্কর বলেন।

তিনি মজার ছলে আরও বলেন, “এটা কিন্তু এমন নয় যে, আমাদের মধ্যে ‘কুট্টি’ হয়ে গেছে,” অর্থাৎ সম্পর্ক ভেঙে যায়নি, কিন্তু মতভেদ স্পষ্ট।

২. রাশিয়ান তেল ইস্যুতে দ্বিচারিতা
ভারতের রাশিয়ান তেল আমদানি নিয়ে মার্কিন চাপ প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর সরাসরি অভিযোগ তোলেন।
তিনি বলেন, “যে যুক্তি দিয়ে ভারতকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, সেই যুক্তি চীন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। অথচ তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক।”

Advertisements

এছাড়া, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “যদি তর্ক হয় যে শতকরা বৃদ্ধি হয়েছে— হ্যাঁ, কেউ কেউ তাদের শতাংশ বাড়ায়নি। কারণ তারা ইরান থেকে তেল কিনেছে, যার বিরুদ্ধেও আমেরিকার আপত্তি রয়েছে।”

তিনি আরও জানান, বাইডেন প্রশাসনের সময় ভারত যে রাশিয়ান তেল কিনছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনার পরই একটি ‘প্রাইস ক্যাপ’ মডেল তৈরি করা হয়েছিল।

৩. পাকিস্তান ইস্যুতে মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রশ্নে জয়শঙ্কর কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন,
“ভারত সরকার কোনও বহিঃস্থ মধ্যস্থতা মেনে নেয় না, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে।”

এমন অবস্থান ভারতের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক নীতি, যা আবারও তিনি স্পষ্ট করলেন।

জয়শঙ্করের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে ভারত নিজস্ব অবস্থানকে আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে চাইছে। তিনি জানান, একদিকে বাণিজ্যিক চাপ, অন্যদিকে জ্বালানি আমদানির দ্বিচারিতা— এই দুইয়ের মাঝেই ভারত নিজের সার্বভৌম স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে।

তিনি বলেন, “বিশ্ব আজ এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে প্রথম ঘোষণা অনেক সময় জনসমক্ষে হয়। ভারতও এই নতুন বাস্তবতায় নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করেই এগোচ্ছে।”

অর্থনৈতিক টাইমস ওয়ার্ল্ড লিডারস ফোরাম ২০২৫-এ জয়শঙ্করের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিল— মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রকাশ্য পররাষ্ট্রনীতি শুধু ভারতকেই নয়, বিশ্বকেই এক নতুন যুগে ঠেলে দিয়েছে। তবে ভারত তার কৃষক, ক্ষুদ্র উৎপাদক ও সার্বভৌম অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস করতে রাজি নয়।