ডার্বি জয়ের পরিসংখ্যানে অনেক এগিয়ে ইস্টবেঙ্গল

কলকাতার ফুটবলের হৃৎপিণ্ডে রয়েছে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যকার ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা কলকাতা ডার্বি নামে পরিচিত। এই ‘বড় ম্যাচ’ শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, বরং বাঙালির আবেগ,…

East Bengal Dominates Kolkata Derby: Statistical Supremacy Over Mohun Bagan in 2025 Durand Cup

কলকাতার ফুটবলের হৃৎপিণ্ডে রয়েছে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যকার ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা কলকাতা ডার্বি নামে পরিচিত। এই ‘বড় ম্যাচ’ শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, বরং বাঙালির আবেগ, পরিচয় এবং সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯২১ সালে কোচবিহার কাপে প্রথম মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে এই দুই দলের মধ্যে শতাধিক ম্যাচ খেলা হয়েছে। পরিসংখ্যানের দিক থেকে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের উপর স্পষ্ট আধিপত্য বজায় রেখেছে। ২০২৫ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত, মোট ৪০৪টি ডার্বি ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল ১৪৩টি জয় পেয়েছে, মোহনবাগান জিতেছে ১৩৩টি ম্যাচে, এবং বাকি ম্যাচগুলো ড্র হয়েছে। এই পরিসংখ্যান ইস্টবেঙ্গলের শ্রেষ্ঠত্বকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে।

ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যকার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকড় গভীর। ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভাজন গড়ে ওঠে। ইস্টবেঙ্গল পূর্ব বাংলার অভিবাসীদের (বাঙাল) প্রতিনিধিত্ব করে, যখন মোহনবাগান পশ্চিম বাংলার স্থানীয়দের (ঘটি) প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিভাজন ডার্বি ম্যাচগুলোকে কেবল খেলার মাঠের লড়াই নয়, বরং একটি সামাজিক যুদ্ধের রূপ দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে এই বিভাজন কিছুটা ম্লান হলেও, মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনও তীব্র এবং আবেগপ্রবণ।

   

প্রধান টুর্নামেন্টে ইস্টবেঙ্গলের আধিপত্য
ইস্টবেঙ্গল বিভিন্ন টুর্নামেন্টে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। আইএফএ শিল্ড, ফেডারেশন কাপ/সুপার কাপ, দুরান্দ কাপ এবং ন্যাশনাল ফুটবল লিগ (এনএফএল)/আই-লিগের মতো প্রতিযোগিতায় ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্স সামগ্রিকভাবে এগিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, আইএফএ শিল্ডে ইস্টবেঙ্গল ২১টি ম্যাচে জয়ী হয়েছে, মোহনবাগানের ৭টি জয়ের বিপরীতে, এবং ১৩টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। ফেডারেশন কাপ/সুপার কাপে ইস্টবেঙ্গল ৯টি জয় পেয়েছে, মোহনবাগান ৬টি, এবং ৮টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। দুরান্দ কাপে ইস্টবেঙ্গল ১০টি জয়ের সঙ্গে এগিয়ে, মোহনবাগানের ৮টি জয়ের তুলনায়। এনএফএল/আই-লিগে দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা কাছাকাছি, যেখানে ইস্টবেঙ্গল ১৬টি এবং মোহনবাগান ১৫টি ম্যাচে জয়ী হয়েছে, এবং ১৩টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। তবে, ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) মোহনবাগানের আধিপত্য লক্ষণীয়।

ইতিহাসের কিছু অবিস্মরণীয় ডার্বি
ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাসে কিছু ডার্বি ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ৫-০ গোলে মোহনবাগানকে পরাজিত করে, যা কলকাতার ফুটবল ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়রা অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করে, এবং এই পরাজয় মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করেছিল। এই ম্যাচের পর একজন মোহনবাগান সমর্থক, উমাকান্ত পালোধি, আত্মহত্যা করেছিলেন, এবং তার আত্মহত্যার নোটে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি পরবর্তী জন্মে মোহনবাগানের খেলোয়াড় হয়ে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবেন।

আরেকটি স্মরণীয় ম্যাচ ছিল ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনাল, যেখানে ইস্টবেঙ্গল ৪-১ গোলে মোহনবাগানকে পরাজিত করে। এই ম্যাচে ভাইচুং ভুটিয়ার হ্যাটট্রিক এবং ১,৩১,৭৮১ দর্শকের উপস্থিতি এটিকে ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা করে তুলেছে। এই ম্যাচ ইস্টবেঙ্গলের কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভুটিয়ার অসাধারণ প্রতিভার প্রমাণ বহন করে।

Advertisements

আইএসএলে মোহনবাগানের প্রাধান্য
আইএসএলে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য আধিপত্য প্রদর্শন করেছে। ২০২০-২১ মরশুম থেকে ২০২৪-২৫ মরশুম পর্যন্ত, মোহনবাগান ১০টি ম্যাচের মধ্যে ৯টিতে জয়ী হয়েছে, এবং একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল এই সময়ে কোনো জয় পায়নি। তবে, ২০২৫ সালের দুরান্দ কাপে ইস্টবেঙ্গল ২-১ গোলে মোহনবাগানকে পরাজিত করে, যা তাদের সমর্থকদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব
কলকাতা ডার্বি শুধুমাত্র একটি ফুটবল ম্যাচ নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক উৎসব। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা জয় উদযাপনের জন্য ইলিশ মাছের পদ তৈরি করে, যখন মোহনবাগানের সমর্থকরা গলদা চিংড়ির পদ দিয়ে উৎসব করে। এই ঐতিহ্য ডার্বির সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে আরও গভীর করে। স্টেডিয়ামে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, ব্যানার, এবং উৎসবমুখর পরিবেশ এই ম্যাচকে বিশ্বের অন্যতম রোমাঞ্চকর ডার্বি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ইস্টবেঙ্গলের পরিসংখ্যানগত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও, মোহনবাগানের সাম্প্রতিক আইএসএল সাফল্য এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও জমজমাট করে তুলেছে। আগামী মরশুমগুলোতে ইস্টবেঙ্গল তাদের ঐতিহাসিক আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে, কলকাতা ডার্বির এই লড়াই বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল জ্বলন্ত থাকবে।