শিলিগুড়ি: বাঙালি অস্মিতা ও ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ফের বড় পদক্ষেপ করলেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব (Gautam Deb)। দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্যে ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে সরব তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে জেলাজুড়ে বার্তা দিয়েছেন। এবার সেই ধারাবাহিকতায় শিলিগুড়ি ও নকশালবাড়িতে দোকানপাটে বাংলায় নামফলক বাধ্যতামূলক করলেন মেয়র।
সম্প্রতি শিলিগুড়ির কলেজপাড়ায় নিজের বাড়ির নামফলকেও পরিবর্তন আনেন মেয়র। এতদিন ইংরেজিতে লেখা ছিল “Goutam Deb, Advocate”। এখন সেই ইংরেজি লেখার পাশেই নতুনভাবে যোগ হয়েছে স্পষ্ট বাংলায় “গৌতম দেব” নামফলক। এটি কেবল প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, বরং পুরো শহরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগের অংশ বলেই জানাচ্ছেন পুরনিগম কর্তৃপক্ষ।
শিলিগুড়ি পুরনিগম ইতিমধ্যেই সব দোকান মালিককে নির্দেশ দিয়েছে—আগামী মহালয়ার মধ্যে অবশ্যই দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। পাশাপাশি নকশালবাড়িতেও জারি হয়েছে একই নির্দেশ। পুরনিগম সূত্রে খবর, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দেশ পালন না করলে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডেপুটি মেয়র রঞ্জন সরকার বলেন, “আমরা শুরু থেকেই পুরনিগমে আমাদের চেম্বারে বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষায় নাম লেখা শুরু করেছি। এটা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। দোকানপাটে বাংলায় নামফলক লিখতেই হবে, সেই নির্দেশ আমরা আগেই দিয়েছি। এখন মেয়রের বাড়িতেও বাংলায় নামফলক বসানো হয়েছে। পৌর নিগমের সমস্ত কাজকর্মে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা ও বাঙালি সুরক্ষিত। ভাষার বিকাশ ও রাজ্যের উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।”
তৃণমূল শিবিরের দাবি—এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে। রাজ্যের প্রতিটি শহর, বাজার ও প্রতিষ্ঠান যাতে বাংলাকে অগ্রাধিকার দেয়, তা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।
তবে বিরোধীরা এই উদ্যোগে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। বিজেপির জেলা নেতা নান্টু পাল বলেন, “রাজ্যে বাঙালিরা চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। আজ আমি কুম্ভকার পাড়ায় গিয়ে মূর্তি গড়া শিল্পীদের অবস্থা দেখে এসেছি—অত্যন্ত করুণ চিত্র। বাংলা ভাষায় নামফলক রাখা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ, কিন্তু প্রশ্ন হল—ভোটের মুখে হঠাৎ এই উদ্দীপনা কেন? ভোট এলেই কি তৃণমূলের বাংলা প্রীতি বেড়ে যায়?”
রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেস ‘বাঙালি পরিচয়’ ও ‘ভাষা সুরক্ষা’ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সমর্থন পোক্ত করতে চাইছে। উত্তরবঙ্গের মতো অঞ্চলে যেখানে জাতিগত ও ভাষাগত পরিচয়ের প্রশ্ন প্রায়ই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে, সেখানে এই ধরনের পদক্ষেপ নির্বাচনী সমীকরণে প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে শিলিগুড়ি ও নকশালবাড়ির ব্যবসায়ী মহল মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অনেকেই বলেছেন, বাংলায় সাইনবোর্ড থাকলে স্থানীয়দের জন্য সুবিধা হবে, আবার কেউ কেউ মনে করছেন, অতিরিক্ত খরচ ও সময়ের চাপ ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি বোঝা হতে পারে।
তবে মেয়র গৌতম দেব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—“বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। এই শহরে বাংলা ভাষার মর্যাদা সর্বোচ্চ রাখতে যা করার আমরা করব।”
ফলে বলা যায়, মহালয়ার আগে শিলিগুড়ি ও নকশালবাড়ি শহরে বাংলায় সাইনবোর্ড বাধ্যতামূলক করার এই সিদ্ধান্ত কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে। এখন দেখার বিষয়—কত দ্রুত এবং কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবসায়ীরা এই নির্দেশ কার্যকর করেন।