কলকাতা, ২৮ জুলাই ২০২৫: ভারতীয় ক্রিকেটের ‘মহারাজ’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) এবং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর (Suvendu Adhikari) মধ্যে একটি নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সোমবার রাতে শুভেন্দু অধিকারী সৌরভের একটি বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তীব্র কটাক্ষ করে বলেছেন, “উনি খেলার লোক, আমি সম্মান করি, তাই এই নিয়ে কিছু বলব না। কিন্তু মমতার টাকায় ব্যবসা করছেন, করুন। এত চাকরিপ্রার্থী থেকে শুরু করে রাজ্যে এত কিছু হয়ে গেল, একবারের জন্যও মুখ খুললেন না। এক চোখে দেখবেন না, দুচোখ খুলে রাখুন।” শুভেন্দুর এই মন্তব্যের পর থেকেই রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়েছে। এই ঘটনা রাজ্যের ক্রীড়া ও রাজনৈতিক মহলের মধ্যে উত্তপ্ত আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং বিসিসিআই-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট, তিনি সম্প্রতি এশিয়া কাপ ২০২৫-এ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি এতে কোনো সমস্যা দেখি না। খেলা চলতেই হবে। তবে, পহেলগাঁওয়ের মতো ঘটনা ঘটা উচিত নয়, কিন্তু খেলা অবশ্যই চলতে হবে। সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই; এটি বন্ধ করতে হবে।” এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই শুভেন্দু তাঁর মন্তব্যে সৌরভকে নিশানা করেছেন। শুভেন্দুর মতে, সৌরভ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে নীরব থাকলেও ক্রিকেটের বিষয়ে মুখ খুলছেন, যা তিনি ‘এক চোখে দেখা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
শুভেন্দুর এই মন্তব্যে ‘মমতার টাকায় ব্যবসা’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে। অনেকের মতে, এটি সৌরভের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ এবং রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যবসায়িক উদ্যোগ, বিশেষ করে তাঁর শিক্ষা ও ক্রীড়া সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো রাজ্যে বেশ সুপরিচিত। তবে, শুভেন্দুর এই অভিযোগে স্পষ্ট কোনো তথ্য বা প্রমাণ উল্লেখ করা হয়নি, যা এই বিতর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে এই মন্তব্য নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের একাংশ শুভেন্দুর এই বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ হিসেবে দেখছে। তৃণমূলের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রীড়াবিদ। তাঁকে এভাবে রাজনীতির মধ্যে টেনে আনা ঠিক নয়। তিনি ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেছেন, এতে রাজনীতি খুঁজে বের করার কী প্রয়োজন?” অন্যদিকে, বিজেপির একাংশ শুভেন্দুর মন্তব্যকে সমর্থন করে বলছে যে, সৌরভের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মুখ খোলা উচিত।
এই বিতর্কের পেছনে রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে। শুভেন্দু অধিকারী, যিনি একসময় তৃণমূলের অন্যতম নেতা ছিলেন, ২০২০ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই মন্তব্য সৌরভকে সরাসরি রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এর আগেও বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। গত বছর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তাঁর মন্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেছিলেন, “এই ধরনের ঘটনা যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে। এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়।” এই বক্তব্যের জন্য তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। এবার শুভেন্দুর মন্তব্যের পর সৌরভ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানান, সেটাই এখন সকলের নজরে।
অন্যদিকে, শুভেন্দুর ‘এক চোখে দেখা’ মন্তব্যটি সৌরভের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সৌরভ সবসময়ই রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর মূল লক্ষ্য ক্রিকেট এবং ব্যবসায়িক কার্যকলাপ। তবে, শুভেন্দুর এই মন্তব্যের পর তাঁকে হয়তো এই বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখতে হবে।
রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই বিতর্ক নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কলকাতার একজন সাধারণ নাগরিক বলেন, “সৌরভ আমাদের গর্ব। তিনি ক্রিকেটে যা করেছেন, তা কেউ ভুলতে পারে না। তবে রাজনীতি থেকে তাঁর দূরে থাকাই ভালো।” অন্য একজন বলেন, “শুভেন্দুবাবু ঠিকই বলেছেন। এত বড় বড় ঘটনা ঘটছে, সৌরভের মতো মানুষের মুখ খোলা উচিত।”
এই বিতর্কের মধ্যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিক্রিয়া এখন সকলের নজরে। রাজনীতি ও ক্রীড়ার এই মিশ্রণ কীভাবে এগিয়ে যায়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।