দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভুয়ো “ডিজিটাল জব”-এর আড়ালে চলা এক আন্তর্জাতিক সাইবার প্রতারণা চক্রে জড়িয়ে পড়েছে শতাধিক ভারতীয়। ইতিমধ্যে কম্বোডিয়া থেকে ৩,০০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০৫ জন ভারতীয় ও ৮১ জন পাকিস্তানি। এই চক্রের বিরুদ্ধে ভারতের ইনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেছে।
ইডির তদন্তপত্রে উঠে এসেছে, এই প্রতারণা চক্রের শিকড় রয়েছে কম্বোডিয়া, লাওস ও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল-এ ছড়িয়ে থাকা একাধিক ‘স্ক্যাম সেন্টারে’। বহু ভারতীয় নাগরিককে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে পাচার করে তাদের দিয়ে ডিজিটাল প্রতারণা ও জালিয়াতি করানো হচ্ছিল (Southeast Asia digital job fraud)।
ইনস্টাগ্রাম প্রলোভনে পাচার, তারপর বন্দি ‘স্ক্যাম কারখানায়’
উত্তরপ্রদেশের মানিশ তোমার নামে এক যুবক জানান, তাঁকে ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার ববি কাটারিয়া সিঙ্গাপুরে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে লাওস নিয়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল-এ এক চীনা পরিচালিত কম্পাউন্ডে নিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট কেড়ে জোর করে প্রতারণায় নিযুক্ত করা হয়।
তাঁর বর্ণনায় উঠে আসে, সশস্ত্র নিরাপত্তা ঘেরা ২০–৩০টি বিল্ডিংয়ের কমপাউন্ড, যেখানে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বহু যুবক বন্দি অবস্থায় ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যাম ও ফেক কল সেন্টার প্রতারণা করতে বাধ্য হচ্ছিলেন।
CBI অফিসার সেজে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়
আরেক ভুক্তভোগী, পল নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি দুবাইয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে পৌঁছে যান কম্বোডিয়ার Poim Phet নামের এক “ডিজিটাল অ্যারেস্ট স্ক্যাম” সেন্টারে। সেখানে তাঁকে ৭ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে CBI অফিসারের পরিচয়ে ভারতের নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের কাজ দেওয়া হয়।
পল বলেন, “আমার কাজ ছিল হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে লিপসিঙ্ক করিয়ে হিন্দি, মারাঠি, বাংলা ভাষায় ভয় দেখানো।” তিনি স্বীকার করেন, এক ব্যক্তির কাছ থেকে ₹৭৫,০০০ আদায় করেছিলেন।
এই স্ক্যাম সেন্টারগুলোতে তিনটি ‘লাইন’ কাজ করে—
লাইন ১: TRAI পরিচয়ে প্রাথমিক ভয়
লাইন ২: পুলিশের ভূমিকায় ভয় দেখানো
লাইন ৩: ভুয়ো ডেপুটি কমিশনার পরিচয়ে “সহায়তার অফার”
স্ক্যামে ব্যবহৃত হয় iPhone (IP ট্র্যাক এড়াতে), Bria নামক VOIP অ্যাপ, থাইল্যান্ড থেকে কেনা ফেক ফোনলাইন। পাকিস্তানি কর্মীরা প্রশিক্ষিত ছিল ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ভয় দেখাতে।
ক্রিপ্টো কারেন্সির ছদ্মপথে ১৫৯ কোটির প্রতারণা, বহু ভারতীয় গ্রেফতার
ইডি সূত্রে জানা গেছে, ₹১৫৯ কোটির আন্তর্জাতিক জালিয়াতি চক্র তদন্তের আওতায় এসেছে। এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ টাকা ক্রিপ্টো ওয়ালেট-এর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। ভারতে থাকা ৩ কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইতিমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। আট ভারতীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা শেল কোম্পানি তৈরি ও মানিলন্ডারিংয়ে সহায়তা করেছিল।
হোয়াটসঅ্যাপে ইনভেস্টমেন্ট ফাঁদ: কোটিকোটি টাকার জালিয়াতি
ভারতের একাধিক শহরে এই চক্রের বিরুদ্ধে বড়সড় এফআইআর দায়ের হয়েছে:
ফরিদাবাদ: এক নারী ৭.৫৯ কোটি প্রতারণার শিকার হন
নয়ডা: এক ব্যবসায়ী হারান ৯.০৯ কোটি
ভাতিন্ডা: এক চিকিৎসকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৫.৯৩ কোটি
সব ক্ষেত্রেই ভুয়ো WhatsApp গ্রুপে ICICI বা অন্যান্য ব্যাংকের পরিচয়ে স্ক্যাম চালানো হয়। ইনভেস্টমেন্ট অ্যাপে টাকা পাঠাতে বলা হয় যা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করত চক্র।
‘পিগ-বুচারিং স্ক্যাম’-এর ছকে আবেগের জালে ফাঁদ
এই চক্রে ‘Pig Butchering Scam’ কৌশল প্রয়োগ করা হয়, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তার পর ধোকায় ফেলে ফেক অ্যাপে লগ্নি করায়। ফাঁদে পড়ে বিপুল টাকা হারান সাধারণ মানুষ।
ভারতীয় তদন্তকারীদের দৃষ্টি এখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকে
কম্বোডিয়া ও লাওসে চলা এই চক্র ভাঙতে আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থাগুলির সঙ্গে জোরালো সমন্বয় করছে ইডি। বিশেষ করে ক্রিপ্টো ট্রান্সফার, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ও সাইবার প্রতারণা রুখতে নতুন নিয়মনীতি আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ইডি জানিয়েছে, এই চক্রের মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে ক্রস-বর্ডার তদন্ত ও তথ্য বিনিময় অত্যন্ত জরুরি।