নয়াদিল্লি: ভারতজুড়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রুখতে বড় পদক্ষেপ সুপ্রিম কোর্টের। শুক্রবার দেশের সমস্ত স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও হোস্টেলের জন্য ১৫ দফা বাধ্যতামূলক নির্দেশিকা জারি করল শীর্ষ আদালত (Student suicide prevention India)। এসব গাইডলাইনের মূল লক্ষ্য, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস করা এবং মানসিক সুরক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক গ্যারান্টি গড়ে তোলা।
কী বলছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা?
শিক্ষার্থীদের উপর পরীক্ষার চাপ, পড়াশোনার চাপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহানুভূতির অভাব যে আত্মহননের মূল কারণ, তা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছে কোর্ট। সেই প্রেক্ষিতেই একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবশ্যিক মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পরীক্ষার সময় বা অ্যাকাডেমিক ট্রানজিশনের সময়ে ছোট ছোট গ্রুপে ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিয়োজিত মেন্টর বা কাউন্সেলর রাখতে হবে, যারা তাদের সঙ্গে নিয়মিত ও গোপনীয়ভাবে কথা বলবেন।
মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ
শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীদের বছরে অন্তত দু’বার মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রশিক্ষণ দেবেন স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদাররা। এই প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকবে, মানসিক অবসাদের সংকেত চিহ্নিত করা, প্রাথমিক মানসিক সাহায্য, আত্মহানির সম্ভাবনা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া এবং যথাযথ রেফারাল প্রক্রিয়া।
পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আচরণে প্রশিক্ষণ দেওয়া বাধ্যতামূলক।
আভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থা, র্যাগিং বা অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে কাজ করার জন্য আভ্যন্তরীণ কমিটি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আক্রান্তদের মানসিক সহায়তা দিতে হবে।
ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা, ইমোশনাল রেগুলেশন ও জীবনদক্ষতা বিষয়ক কার্যক্রম নিয়মিত করতে হবে। অভিভাবকদের জন্য সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি কর্মসূচি চালু করতে হবে।
ছাত্রদের মানসিক সুস্থতা সংক্রান্ত তথ্য রেকর্ড রাখতে হবে, তবে তা নাম গোপন রেখে (anonymised) রাখতে হবে।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে হেল্পলাইন নম্বর (যেমন Tele-MANAS সহ অন্যান্য জাতীয় পরিষেবা) হোস্টেল, ক্লাসরুম, সাধারণ জায়গা এবং ওয়েবসাইটে বড় অক্ষরে দৃশ্যমানভাবে প্রদর্শন করতে হবে।
উদ্বেগের পরিসংখ্যান
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১৩,০৪৪ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ দেশের প্রতি ১০০টি আত্মহত্যার মধ্যে অন্তত ৮টি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঘটেছে। পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ২,২৪৮টি।
২০০১ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৫,৪২৫। অর্থাৎ দুই দশকে ছাত্র আত্মহত্যার ঘটনা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
সাংবিধানিক ভিত্তি
জাস্টিস বিক্রম নাথ ও জাস্টিস সন্দীপ মেহতা-র বেঞ্চ জানিয়েছে, সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের আওতায় এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এই গাইডলাইন আইন বলেই গণ্য হবে যতক্ষণ না সংসদ বা রাজ্যসভা আলাদা আইন প্রণয়ন করে।
এই নির্দেশিকা জাতীয় ছাত্র মানসিক স্বাস্থ্য টাস্ক ফোর্সের কাজের সম্পূরক হিসেবেও বিবেচিত হবে। উক্ত টাস্ক ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রাক্তন সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি রবিশঙ্কর ভাট।
যে ঘটনায় সূত্রপাত
২০২৩ সালের ১৪ জুলাই, অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে NEET-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ১৭ বছরের এক ছাত্রী। তিনি হোস্টেলে থাকতেন এবং একটি কোচিং সেন্টারে পড়তেন। সেখানেই তিনি আত্মহত্যা করেন।
তার পরিবারের তরফে CBI তদন্তের দাবি জানানো হয়, যা অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। পরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা যায় এবং শীর্ষ আদালত CBI তদন্তের নির্দেশ দেয়। সেই শুনানির সময়েই সুপ্রিম কোর্ট এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা দেয়।