রাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন হিলি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ছত্তিশগঢ়ে দীর্ঘদিন বসবাসকারী এক দম্পতিকে। বিস্ময়করভাবে ধৃত দুই ব্যক্তিই বাংলাদেশের নাগরিক (Illegal Immigration) বলে স্বীকার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁরা প্রায় ৩০ বছর আগে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন এবং তারপর থেকেই ছত্তিশগঢ়ে বসবাস করছিলেন। এই ঘটনা শুধু সীমান্ত সুরক্ষা নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিতর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ধৃতদের পরিচয় ও গ্রেফতার
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হিলি আন্তর্জাতিক সীমান্ত চৌকিতে বিএসএফ একটি গোপন সূত্রে অভিযান চালিয়ে ওই দম্পতিকে গ্রেফতার করে। ধৃতরা হলেন ইমরান শেখ (৫৫) এবং তাঁর স্ত্রী জয়নাব বিবি (৫০)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের আদি বাড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার একটি বন্দর সংলগ্ন এলাকায়। তাঁরা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে ছত্তিশগঢ় রাজ্যের একটি গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করছিলেন।
চাপের মুখে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা
সম্প্রতি ছত্তিশগঢ় সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণু দেও সাইয়ের নির্দেশে প্রতিটি জেলায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত ও বহিষ্কারের জন্য অভিযান শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে ইমরান ও জয়নাব বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে হিলি সীমান্তে বিএসএফের কড়া নজরদারিতে তাঁরা ধরা পড়ে যান।
উদ্ধার নথি ও সন্দেহ
তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে একাধিক ভারতীয় পরিচয়পত্র, যার মধ্যে রয়েছে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, এমনকি ভোটার আইডিও। এই নথিপত্রগুলি জাল কিনা, তা যাচাই করছে বিএসএফ ও স্থানীয় পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, একটি বড় জালিয়াতি চক্রের মাধ্যমে তাঁরা এসব নথি সংগ্রহ করেছিলেন। গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন রাজ্যে জাল নথি সরবরাহকারী চক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দিল্লি পুলিশও গত ডিসেম্বরে এমনই একটি চক্রের ১১ জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই ঘটনা সামনে আসতেই তৃণমূল কংগ্রেস নতুন করে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একাধিকবার দাবি করেছেন, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছত্তিশগঢ়ের ঘটনা তার সাম্প্রতিক প্রমাণ বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেত্রী। তিনি জানান, সেখানে কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের নেতৃত্বে কিছু বাঙালিকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে, যাঁদের ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করা হয়েছিল।
সীমান্ত সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরেই অনুপ্রবেশের জন্য উদ্বেগের কারণ। ২০২১ সালের একটি সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছে বলে আশঙ্কা করা হয়। এই অনুপ্রবেশ রোধে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) এবং বিদেশি আইন, ১৯৪৬ প্রয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
News coming in from #SouthDinajpur district of #WestBengal.
BSF detained 2 Bangladeshi Muslim infiltrators near #Hili international borders on their way back to Bangladesh.
They are Imran Sheikh (55) and Jainab Bibi(50).
During interrogation, they said that they illegally… pic.twitter.com/wAdsAT0c4R
— Hindu Voice (@HinduVoice_in) July 17, 2025
সরকারি প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বারবার জানিয়েছে, দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ জরুরি। এনআরসি প্রক্রিয়া ও সীমান্তে প্রযুক্তিগত নজরদারির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এই দম্পতির মতো বহু ব্যক্তি যদি বছরের পর বছর ছত্তিশগঢ় বা অন্য রাজ্যে থেকে যান, তা হলে সীমান্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই হয়।
জনমনে উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই ঘটনার পর হিলি সীমান্ত ও অন্যান্য চিহ্নিত এলাকায় বিএসএফ তাদের তৎপরতা আরও জোরদার করেছে। একইসঙ্গে, রাজ্য পুলিশও স্থানীয় অভিবাসীদের নথি খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করেছে। ছত্তিশগঢ়েও ফের বড় মাপের তল্লাশি অভিযান চালানোর প্রস্তুতি চলছে।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, অবৈধ অনুপ্রবেশ শুধু একটি সীমান্ত সমস্যা নয়—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির একটি পরীক্ষা। আগামী দিনে এই ধরনের ঘটনা ঠেকাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে। না হলে, দেশজুড়ে নিরাপত্তার জাল থাকলেও, চোরাপথে প্রবেশ রোধ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে।