কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে এই কমিশনের মাধ্যমে কর্মচারীদের মাসিক বেতন ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে এই দাবি কতটা সত্য, আর কতটা অতিরঞ্জিত বা ফাঁদ—এই প্রশ্ন এখন সবার মনে। ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে এই কমিশন কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে, এবং এটি প্রায় ১.১২ কোটি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের প্রভাবিত করবে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই বেতন বৃদ্ধির দাবির সত্যতা এবং এর পেছনের যুক্তিগুলি বিশ্লেষণ করব।
অষ্টম বেতন কমিশনের পটভূমি
অষ্টম বেতন কমিশন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের শুরু থেকে, যখন সরকার এটি গঠনের ঘোষণা করে। সপ্তম বেতন কমিশন ২০১৬ সালে কার্যকর হয়েছিল, যার মাধ্যমে ন্যূনতম মূল বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮,০০০ টাকা হয়েছিল, এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭। এই কমিশনের ফলে বেতন বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১৪.৩%, যা ১৯৭০ সালের পর সর্বনিম্ন। এবার অষ্টম বেতন কমিশনের মাধ্যমে ৩০-৩৪% বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে বলে একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
এই বেতন বৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, যা বর্তমান মূল বেতনকে গুণ করে নতুন বেতন নির্ধারণ করে। সপ্তম বেতন কমিশনে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, এবং এবার এটি ১.৮৩ থেকে ২.৪৬ এর মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৪৬ হয়, তাহলে ন্যূনতম মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৪,২৮০ টাকা হতে পারে। তবে, মহার্ঘ ভাতা (DA) রিসেট করা হলে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি এতটা নাও হতে পারে।
২০,০০০ টাকার বেতন বৃদ্ধি: সত্য না ফাঁদ?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং কিছু সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে অষ্টম বেতন কমিশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের মাসিক বেতন ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কর্মচারীর বর্তমান মূল বেতন ৪০,০০০ টাকা হয় এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.১৫ ধরা হয়, তাহলে নতুন মূল বেতন হতে পারে ৮৬,০০০ টাকা। মহার্ঘ ভাতা এবং অন্যান্য ভাতা (যেমন এইচআরএ, ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স) যোগ করলে মোট বেতন ১,০৯,০০০ টাকার কাছাকাছি হতে পারে। এই হিসেবে, মোট বেতন বৃদ্ধি বর্তমান বেতনের তুলনায় ২০,০০০ টাকা বা তার বেশি হতে পারে।
তবে, এই দাবি পুরোপুরি সত্য নয়। প্রথমত, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এখনও চূড়ান্ত হয়নি, এবং এটি ১.৮৩ থেকে ২.৪৬ এর মধ্যে হতে পারে। যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৮৩ হয়, তাহলে ন্যূনতম মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩২,৯৪০ টাকা হবে, যা ২০,০০০ টাকার বেতন বৃদ্ধির দাবির তুলনায় অনেক কম। দ্বিতীয়ত, মহার্ঘ ভাতা নতুন কমিশনের শুরুতে শূন্যে রিসেট করা হয়, ফলে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি ১৪-২০% এর মধ্যে হতে পারে। অতএব, ২০,০০০ টাকার বেতন বৃদ্ধির দাবি কিছুটা অতিরঞ্জিত এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, তবে সব কর্মচারীর জন্য নয়।
অন্যান্য সুবিধা
বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি, অষ্টম বেতন কমিশন পেনশনভোগীদের জন্য ফিক্সড মেডিকেল অ্যালাউন্স (FMA) ১,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩,০০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। এছাড়াও, হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স (HRA) এবং ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্সেও পরিবর্তন আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি মূল বেতন ৯০,০০০ টাকা হয়, তাহলে এইচআরএ ২৪% হারে ২১,৬০০ টাকা হতে পারে। এই ভাতাগুলি মোট বেতন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
অষ্টম বেতন কমিশনের ফলে সরকারের ব্যয় বাড়বে প্রায় ১.৮ লাখ কোটি টাকা, যা ভারতের অর্থনীতিতে উপভোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই বেতন বৃদ্ধি কেন্দ্রীয় কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে, যা ভোক্তা বাজারে চাহিদা বাড়াতে পারে। তবে, এই বৃদ্ধি সরকারের বাজেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, এবং এর ফলে কর বৃদ্ধি বা অন্যান্য খাতে ব্যয় হ্রাসের সম্ভাবনা থাকতে পারে।
সমালোচনা ও উদ্বেগ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ব্যক্তি এই বেতন বৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন, দাবি করে যে এটি করদাতাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের কর্মচারীরা মনে করেন যে সরকারি কর্মচারীদের এই বড় বেতন বৃদ্ধি বেসরকারি খাতের তুলনায় অসমতা সৃষ্টি করছে। এছাড়াও, কমিশনের গঠন এবং এর শর্তাবলী নিয়ে বিলম্বের জন্য কিছু কর্মচারী সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
অষ্টম বেতন কমিশন নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, মাসিক ২০,০০০ টাকার বেতন বৃদ্ধির দাবি কিছুটা অতিরঞ্জিত, এবং প্রকৃত বৃদ্ধি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর এবং মহার্ঘ ভাতার উপর নির্ভর করবে। যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর উচ্চ হয় এবং ভাতাগুলি যথাযথভাবে সংশোধন করা হয়, তাহলে উল্লেখযোগ্য বেতন বৃদ্ধি সম্ভব। তবে, কর্মচারীদের এই দাবির পেছনের সত্যতা যাচাই করা উচিত এবং অষ্টম বেতন কমিশনের চূড়ান্ত ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করা উচিত।