ভারতের কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবিকার প্রধান উৎস, বর্তমানে একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কৃষি স্টার্টআপগুলি (Agri Startups India) উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় কৃষিকে আরও উৎপাদনশীল, টেকসই এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলছে। এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের জন্য স্মার্ট সমাধান প্রদান করছে, যা ফসলের উৎপাদন বাড়ানো থেকে শুরু করে মাটির স্বাস্থ্য এবং জল ব্যবস্থাপনার উন্নতি পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০২৫ সালে, কিছু উল্লেখযোগ্য অ্যাগ্রি স্টার্টআপ ভারতের কৃষি ল্যান্ডস্কেপকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এমন কয়েকটি স্টার্টআপের উপর আলোকপাত করব যারা তাদের উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আনছে।
ফার্মোলজি: কলকাতার গর্ব
কলকাতা-ভিত্তিক স্টার্টআপ ফার্মোলজি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ভারতের কৃষি খাতে একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই স্টার্টআপটি কৃষকদের জন্য স্যাটেলাইট-ভিত্তিক এআই-চালিত প্রিসিশন ফার্মিং প্রযুক্তি প্রদান করে, যা ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, মাটির উর্বরতা ব্যবস্থাপনা এবং বাজার সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ফার্মোলজি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং অন্যান্য রাজ্যের ৩৫,০০০-এর বেশি কৃষকের কাছে পৌঁছেছে, যারা ধান, আলু, চা এবং কলার মতো ফসল চাষে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তাদের মোবাইল অ্যাপ এবং সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক মডেল কৃষকদের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারকে সহজ এবং সাশ্রয়ী করেছে। ফার্মোলজির ব্লকচেইন-ভিত্তিক ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম কৃষকদের তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণমান প্রমাণ করতে এবং বাজারে ভালো দাম পেতে সহায়তা করে। এই স্টার্টআপটি কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ঈকি: জলবায়ু-প্রতিরোধী কৃষির পথপ্রদর্শক
কোটা-ভিত্তিক স্টার্টআপ ঈকি ভারতের কৃষি খাতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম। আইআইটি বম্বের প্রাক্তন ছাত্র অভয় সিং এবং অমিত কুমারের প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপটি এয়ারোপনিক ফার্মিং প্রযুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু-প্রতিরোধী কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। ঈকি সম্প্রতি সিক্সথ সেন্স ভেঞ্চারসের নেতৃত্বে ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে, যা তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণে সহায়তা করবে। এয়ারোপনিক পদ্ধতি মাটি ছাড়াই ফসল উৎপাদনের জন্য কম জল এবং পুষ্টির ব্যবহার করে, যা জলের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর। ঈকির প্রযুক্তি কৃষকদের সারা বছর ধরে কীটনাশক-মুক্ত সবজি উৎপাদন করতে সক্ষম করছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। এই স্টার্টআপটি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো অঞ্চলে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, যেখানে কৃষকরা ঐতিহ্যবাহী চাষের পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করছেন।

নিনজাকার্ট: সরবরাহ শৃঙ্খলের বিপ্লব
নিনজাকার্ট ভারতের কৃষি সরবরাহ শৃঙ্খলাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। এই বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক স্টার্টআপ কৃষকদের সরাসরি খুচরা বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের সাথে সংযুক্ত করছে, মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা হ্রাস করে এবং কৃষকদের জন্য ভালো দাম নিশ্চিত করছে। তাদের এআই-ভিত্তিক চাহিদা পূর্বাভাস এবং লজিস্টিক অপ্টিমাইজেশন প্রযুক্তি ফসলের অপচয় কমিয়ে কৃষকদের আয় বাড়াচ্ছে। নিনজাকার্টের প্ল্যাটফর্ম কৃষি-ইনপুট সরবরাহ, উপদেশমূলক পরিষেবা এবং বাজার সংযোগ প্রদান করে, যা কৃষকদের জন্য একটি সমন্বিত সমাধান হিসেবে কাজ করে। এই স্টার্টআপটি ভারতের কৃষি খাতে ডিজিটাল রূপান্তরের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
উপজাও অ্যাগ্রোটেক: এআই-চালিত গুণমান পরীক্ষা
গুজরাট সরকার এবং নাসকমের সমর্থনে উপজাও অ্যাগ্রোটেক ভারতের কৃষিতে এআই-ভিত্তিক গুণমান পরীক্ষার মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এই স্টার্টআপ শস্যের গুণমান মূল্যায়নে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা কৃষকদের দ্রুত এবং সঠিক ফলাফল প্রদান করে। ঐতিহ্যগত ল্যাব-ভিত্তিক পরীক্ষার তুলনায় এই পদ্ধতি সময় এবং খরচ সাশ্রয় করে। উপজাও অ্যাগ্রোটেকের প্রযুক্তি কৃষকদের তাদের পণ্যের গুণমান উন্নত করতে এবং বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জনে সহায়তা করছে।
হার্ভেল এভিয়েশন: ড্রোন-ভিত্তিক কৃষি সমাধান
ভারতীয় স্টার্টআপ হার্ভেল এভিয়েশন কৃষিতে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের ব্যাটারি-চালিত কৃষি ড্রোনগুলি স্প্রে করা, বীজ বপন এবং ফসল পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এই ড্রোনগুলি সেন্সর এবং জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীটনাশক এবং সারের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ নিশ্চিত করে, যা সম্পদের অপচয় কমায় এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। হার্ভেল এভিয়েশন কৃষকদের জন্য একটি সাশ্রয়ী এবং দক্ষ সমাধান প্রদান করছে, যা বিশেষ করে ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য উপকারী।
টেকসই কৃষি এবং ভবিষ্যৎ
এই স্টার্টআপগুলি কেবল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে না, বরং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফার্মোলজি, ঈকি, নিনজাকার্ট এবং হার্ভেল এভিয়েশনের মতো স্টার্টআপগুলি কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তন, জলের অভাব এবং মাটির স্বাস্থ্য হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করছে। এআই, ড্রোন, ব্লকচেইন এবং মোবাইল অ্যাপের মতো প্রযুক্তি কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে এই স্টার্টআপগুলি ভারতের কৃষি খাতকে আরও সমৃদ্ধ এবং স্থিতিস্থাপক করে তুলছে।
২০২৫ সালে ভারতের কৃষি খাতে প্রযুক্তির ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির সমর্থনে এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতে, যেখানে কৃষি এবং মৎস্য চাষ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এই উদ্ভাবনগুলি কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে। ভবিষ্যতে, এই স্টার্টআপগুলির প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন ভারতের কৃষি খাতকে বিশ্বের শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে, যা দেশের অর্থনীতি এবং পরিবেশের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।