সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, শুধুমাত্র তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্যই নয়, বরং এখানকার কৃষকদের জীবনে আসা দ্বৈত সংকট—লবণাক্ততা এবং বাঘের আক্রমণের জন্যও পরিচিত। ২০২৫ সালে এই অঞ্চলের কৃষকরা (Sundarbans Farmers) ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে কৃষি উৎপাদনের ক্ষতি এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আক্রমণের ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এই সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এই নিবন্ধে আমরা সুন্দরবনের কৃষকদের এই দুটি চ্যালেঞ্জ এবং তাদের জীবনযাত্রার উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
লবণাক্ততার ক্রমবর্ধমান হুমকি
সুন্দরবনের কৃষকদের জন্য লবণাক্ততা একটি প্রধান সমস্যা। গত দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নদীর জলের লবণাক্ততা ১৫% বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় যেমন আইলা (২০০৯), বুলবুল (২০১৯), আমফান (২০২০) এবং ইয়াস (২০২১) এই অঞ্চলের কৃষিজমি লবণাক্ত জলের নিচে তলিয়ে দিয়েছে। ফলে, কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক জমি ২-৩ বছরের জন্য চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সুন্দরী গাছ, যা এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বনের প্রধান প্রজাতি, লবণাক্ততার কারণে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কৃষকদের জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, যারা প্রধানত কৃষি এবং মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল।
লবণাক্ত জলের কারণে মাছের প্রজননও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকাকে আরও সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেক কৃষক এবং মৎস্যজীবী তাদের জীবিকার জন্য বনের গভীরে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যেখানে তারা মধু, কাঠ এবং কাঁকড়া সংগ্রহ করেন। এই কাজগুলো তাদের আয়ের একটি বড় অংশ সরবরাহ করে, তবে এটি তাদের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
বাঘের আক্রমণ: একটি ভয়াবহ বাস্তবতা
সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা প্রায় ১০০-১৩০, যা বিশ্বের বৃহত্তম একক টাইগার জনসংখ্যার মধ্যে একটি। এই বাঘগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দক্ষ সাঁতারু, যারা ছোট কাঠের নৌকায় আক্রমণ করতে সক্ষম। ২০২৫ সালে, বাঘের আক্রমণে প্রতি বছর ৪০-১০০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন বলে ধারণা করা হয়, যদিও অনেক ঘটনা অবৈধভাবে বনে প্রবেশের কারণে রিপোর্ট করা হয় না। সুন্দরবনের বাঘগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি আক্রমণাত্মক বলে মনে করা হয়, যার সম্ভাব্য কারণ হলো লবণাক্ত জল এবং শিকারের অভাব।
কৃষক এবং মৎস্যজীবীরা যখন বনের গভীরে মধু, কাঁকড়া বা কাঠ সংগ্রহ করতে যান, তখন তারা সহজেই বাঘের শিকারে পরিণত হন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে, কোভিড-১৯ মহামারীর সময়, শহরে অর্থনৈতিক সুযোগ হ্রাস পাওয়ায় অনেকে গ্রামে ফিরে এসে বনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে, বাঘের আক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা বনবিবি এবং দক্ষিণ রায়ের কাছে প্রার্থনা করেন এবং মাথার পিছনে মুখোশ পরেন, কারণ বাঘরা সাধারণত পিছন থেকে আক্রমণ করে। তবে, এই কৌশলগুলো বাঘদের কাছে এখন আর কার্যকর নয়, কারণ তারা এই কৌশল শিখে ফেলেছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
বাঘের আক্রমণে স্বামী হারানো মহিলারা, যাদের ‘বাঘ-বিধবা’ বলা হয়, সমাজে প্রচণ্ড বৈষম্যের শিকার হন। স্থানীয় কুসংস্কার অনুসারে, এই মহিলাদের অভিশপ্ত মনে করা হয় এবং তাদের দোষ দেওয়া হয় তাদের স্বামীর মৃত্যুর জন্য। অনেক সময় তাদের শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং তারা তাদের সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সুন্দরবনে প্রায় ৩,০০০ বাঘ-বিধবা রয়েছেন, যারা দারিদ্র্য এবং সামাজিক বঞ্চনার মধ্যে জীবনযাপন করেন। এই মহিলারা প্রায়ই কোনো আর্থিক সহায়তা ছাড়াই জীবিকা নির্বাহের জন্য বনে ফিরে যান, যা তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
সরকার বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নীতি ঘোষণা করেছে, তবে এই অর্থ পাওয়া অত্যন্ত জটিল এবং কাগজপত্রের অভাবে অনেকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। উদাহরণস্বরূপ, সরোজিনী মণ্ডল এবং সরস্বতী আউলিয়া, যাদের স্বামীরা ২০১৯ সালে বাঘের আক্রমণে মারা যান, কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পর ২০২৪ সালে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।
সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ
সুন্দরবনে মানুষ-বাঘ সংঘাত কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার নাইলনের জাল বেড়া স্থাপন করেছে, যা বাঘ এবং মানুষের মধ্যে সীমানা তৈরি করে। এই বেড়া বাঘদের গ্রামে প্রবেশ এবং মানুষের বনের গভীরে যাওয়া রোধ করতে সাহায্য করেছে। তবে, এই বেড়াগুলো প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ একটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়া, সরকার মৎস্যজীবীদের জন্য পোর্টেবল গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করছে, যাতে তারা কাঠ সংগ্রহের জন্য বনে না যায়।
স্থানীয় সংগঠন, যেমন সুন্দরবন বাঘ-বিধবা কল্যাণ সমিতি, এই মহিলাদের সহায়তা করছে। তারা আইনি সহায়তা প্রদান করে এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করতে সহায়তা করে। এছাড়া, কিছু বাঘ-বিধবা সুন্দরী গাছ রোপণের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে অংশ নিচ্ছেন, যা তাদের আয়ের একটি নতুন উৎস হয়ে উঠেছে।
সুন্দরবনের কৃষকদের জন্য লবণাক্ততা এবং বাঘের আক্রমণ একটি দ্বৈত সংকট, যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণে আরও তীব্র হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ এবং স্থানীয় সংগঠনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এই সমস্যার সমাধান এখনও অধরা। কৃষক এবং মৎস্যজীবীদের জীবিকার বিকল্প উৎস প্রদান, ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া সহজ করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে আরও বিনিয়োগ এই সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। সুন্দরবনের কৃষকদের জীবন রক্ষা এবং তাদের জীবিকা নিশ্চিত করতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।