Rath Yatra Controversy: মালদা জেলার কালিয়াচক থানার আওতাধীন জলালপুর গ্রামে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়া ৬২৯ বছর পুরোনো জলালপুর রথযাত্রা এবার আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে এসে পড়েছে। এই প্রাচীন ধর্মীয় উৎসবটি শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত প্রমাণ। তবে, জমির মালিকানার বিতর্ক, আইনি জটিলতা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রভাবের কারণে এই উৎসবটি বহু বছর ধরে বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে কালিয়াচক থানার উদ্যোগে পুলিশের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ওঠার পর এই রথযাত্রা পুনরায় শুরু হয়। তবে, সম্প্রতি বিভিন্ন দিক থেকে উঠে আসা বিভ্রান্তিকর তথ্য ও বিতর্কের মুখে মালদা জেলা পুলিশ অবশেষে মুখ খুলেছে।
রথযাত্রার ইতিহাস ও বিতর্কের শুরু
জলালপুর রথযাত্রার ইতিহাস অন্তত ১৪০০ শতকের শুরুতে ফিরে যায়, যখন এই এলাকায় সনাতন ধর্মের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে, এই উৎসবটি মোঘল আমলের আগে থেকেই চলছিল, যা এটিকে ৬২৯ বছরের পুরোনো করে তোলে। তবে, সময়ের সাথে সাথে জমির মালিকানা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়, যা এই উৎসবকে বন্ধের দিকে ঠেলে দেয়। জালালপুর রথ সংস্কার কমিটির সভাপতি বুদ্ধদেব ঘোষ এবং সম্পাদক গৌতম মন্ডলের নেতৃত্বে কমিটি এবং জমির মালিক শংকর প্রসাদ চৌধুরী (স্বর্গীয় ক্ষিতীশ চৌধুরীর পুত্র) এর মধ্যে এই বিতর্ক চলছিল। জমির ক্ষতি এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উপর আপত্তির কারণে মালিক পক্ষটি মেলা বা দোকানপাটের অনুমতি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
২০০৫ এবং ২০০৯ সালে রথযাত্রার সাথে সংযুক্ত মেলায় গুরুতর আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে, যার ফলে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলোর পর প্রশাসন মেলার উপর পুরোপুরি নিষেধ আরোপ করে। এই পটভূমিতে, ২০২২ সালে কালিয়াচক থানা উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছায়। জমির মালিকরা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য একটি অনাপত্তি পত্র (NOC) দিয়ে সম্মতি জানান, কিন্তু বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুমতি প্রদান করেননি।
পুলিশের বিবৃতি ও আইনি অবস্থান
মালদা জেলা পুলিশের সাম্প্রতিক পোস্টে জানানো হয়েছে যে, জলালপুর রথযাত্রা নিয়ে কিছু ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়ানো হচ্ছে, যা বাণিজ্যিক স্বার্থে করা হতে পারে। পুলিশ জানিয়েছে যে, জমি এখনও আইনি বিবাদে জড়িত এবং এই মামলা আদালতে বিচারাধীন। তবে, ধর্মীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে রথযাত্রা চালু রাখা হয়েছে। মাননীয় কলকাতা হাইকোর্টও সম্প্রতি প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে মেলার অনুমতি প্রদানের আবেদন খারিজ করেছেন।
পুলিশের মতে, তাদের হস্তক্ষেপের ফলে শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা পুনরায় শুরু হয়েছে এবং এটি প্রতি বছর নির্দিষ্ট পুলিশি নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে, জনগণকে বিভ্রান্তিকর গুজব থেকে দূরে থাকতে এবং শান্তিপূর্ণ উৎসব পালনের জন্য সহযোগিতা করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
রথযাত্রা কমিটি ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া
এদিকে, জলালপুর রথ সংস্কার কমিটির সম্পাদক গৌতম মন্ডল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। তিনি জানান, “রথ মেলা ৬২৯ বছর ধরে চলছে এবং এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। পুলিশের এই সিদ্ধান্ত একটি ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছে।” তিনি অভিযোগ করেন যে, এই বন্ধন রাজনৈতিক স্বার্থে প্রভাবিত হয়েছে। স্থানীয় বিজেপি নেতা অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ও এই সিদ্ধান্তকে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন এবং এটিকে হিন্দু উৎসবের উপর হামলা হিসেবে বর্ণনা করছেন।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী জানান, “পুলিশের সিদ্ধান্তটি কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে। গত ঘটনাগুলো বিবেচনা করে এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।” তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, রথযাত্রা চলবে, কিন্তু মেলা বন্ধ করা গুরুতর আইনি ও নিরাপত্তা বিবেচনার মূলে রয়েছে।
আইনি দৃষ্টিকোণ ও হাইকোর্টের ভূমিকা
কলকাতা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি এই বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ক। আদালত জানিয়েছে যে, জমির মালিকানার বিবাদ এবং পূর্বের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা বিবেচনা করে মেলার অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। এই রায়টি প্রশাসনের পক্ষে একটি শক্তিশালী সমর্থন হিসেবে কাজ করেছে। তবে, এই সিদ্ধান্তের বিরোধীদের মতে, এটি সংস্কৃতির উপর একটি অবৈধ হস্তক্ষেপ।
সমাজে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
এই বিতর্ক স্থানীয় সমাজে বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি করেছে। কিছু ব্যক্তি এটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হামলা হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে কিছু জন এটিকে নিরাপত্তা ও আইনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করছেন। এই বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ এখনও সতর্ক রয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ উৎসবের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জলালপুর রথযাত্রা বিতর্ক ঐতিহ্য, আইন এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের মধ্যে একটি জটিল সংঘাতের পরিচয়। পুলিশের ভূমিকা এখানে শুধুমাত্র নিরাপত্তা রক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সংস্কৃতির সংরক্ষণে একটি অস্বাভাবিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আদালতের রায় এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমন্বয়ই এই বিতর্কের সমাধান নির্ধারণ করবে।