মিলন পণ্ডা, দিঘা: পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা, শঙ্করপুর, পেটুয়াঘাট সহ উপকূলবর্তী এলাকাগুলো এখন তৎপরতায় মুখর। কারণ, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই শেষ হচ্ছে ৬১ দিনের মৎস্য শিকারের (Hilsa Fishing) নিষেধাজ্ঞা বা ব্যান পিরিয়ড। শনিবার (১৪ জুন, ২০২৫) মধ্যরাত থেকে হাজার হাজার ট্রলার ও নৌকা গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেবে ইলিশের সন্ধানে। মৎস্যজীবীদের মধ্যে উৎসাহ ও ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। ট্রলারে রং করা, তেল ভরা, বরফ মজুত করা থেকে শুরু করে জালের গিঁট শক্ত করা—সব কাজই শেষ মুহূর্তে জোরকদমে চলছে।
প্রতি বছর এপ্রিলের ১৫ তারিখ থেকে জুনের ১৪ তারিখ পর্যন্ত মাছের প্রজনন নিশ্চিত করতে সরকার সমুদ্রে মৎস্য শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই সময়ে মৎস্যজীবীদের জীবিকা বন্ধ থাকে, তবে এই নিষেধাজ্ঞা মাছের প্রজনন ও সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। দিঘা, শঙ্করপুর, রামনগর, খেজুরি, মহিষাদল, কোলাঘাট ও পেটুয়াঘাটের মৎস্যজীবীরা এই নিষেধাজ্ঞা মেনে দু’মাস ধরে অপেক্ষা করেছেন। এখন তাঁরা আবার সমুদ্রে ফিরতে প্রস্তুত।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বাংলার সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের অন্যতম কেন্দ্র। এই জেলার উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা হল মাছ ধরা। কেউ নিজের নৌকা নিয়ে সমুদ্রে যান, কেউ আবার অন্যের ট্রলারে মৎস্যজীবী হিসেবে কাজ করেন। বছরের ১২ মাসের মধ্যে এই ৬১ দিন ছাড়া সমুদ্রই তাঁদের দ্বিতীয় ঘর। বিশেষ করে ইলিশ মাছ, যা বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাঁদের প্রধান লক্ষ্য। তবে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের উৎপাদন কিছুটা কম থাকায় মৎস্যজীবীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়েছে।
ট্রলার মালিক ভানুগোপাল কলা বলেন, “ব্যান পিরিয়ড শেষ হতে চলেছে। সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি জোরকদমে চলছে। গত বছর ইলিশ তেমন পাওয়া যায়নি। এবার আশা করছি, ভালো পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়বে। পূবালী হাওয়া বইলে ইলিশ বেশি ধরা পড়ে।” তিনি আরও জানান, ট্রলারে জ্বালানি, বরফ, খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুত করা হচ্ছে। জালের গিঁট শক্ত করার কাজও শেষ পর্যায়ে।
দিঘা, রামনগর, খেজুরি, মহিষাদল, পেটুয়াঘাট ও কোলাঘাটের প্রায় ২৫০০-এর বেশি ট্রলার গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যাবে। এই ট্রলারগুলোতে হাজার হাজার মৎস্যজীবী কাজ করেন। গত মরশুমে অন্যান্য মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও, ইলিশের উৎপাদন কম ছিল। এবার মৎস্যজীবীরা আশাবাদী যে, ইলিশের প্রাচুর্য তাঁদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।
স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য দীপক সার বলেন, “রাজ্য সরকারের নিয়ম মেনে মৎস্যজীবীরা ৬১ দিন পর আবার সমুদ্রে যাবেন। তাঁরা ইতিমধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। আমরা আশাবাদী, এবার বাঙালির পাতে ইলিশ ফিরবে।” তিনি আরও জানান, সরকার মৎস্যজীবীদের জন্য বিভিন্ন সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে, যা তাঁদের জীবিকাকে আরও সুরক্ষিত করেছে।
এই ব্যান পিরিয়ড মৎস্যজীবীদের জন্য আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হলেও, এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা মাছের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এবার মৎস্যজীবীরা আশায় বুক বেঁধেছেন যে, সমুদ্র তাঁদের হতাশ করবে না। দিঘা ও শঙ্করপুরের মৎস্য বন্দরগুলো এখন প্রাণচঞ্চল। ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ, জাল বাঁধার কাজ আর মৎস্যজীবীদের উৎসাহে এলাকায় উৎসবের আমেজ।
এই সময়ে প্রশাসনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সমুদ্রে মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোস্ট গার্ড ও পুলিশ সতর্ক রয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যবেক্ষণ করে ঝড়-ঝঞ্ঝার আশঙ্কা থাকলে সতর্কতা জারি করা হবে। মৎস্যজীবীদের জন্য জীবনবীমা ও অন্যান্য সুবিধাও সরকারের তরফে প্রদান করা হচ্ছে।
ইলিশের জন্য বাঙালির প্রেম অপরিসীম। এবারের মৎস্য শিকার মরশুমে যদি ইলিশের প্রাচুর্য ঘটে, তবে তা শুধু মৎস্যজীবীদের নয়, বাঙালির পাতেও উৎসব ফিরিয়ে আনবে। সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার এই অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা—ইলিশ কি ফিরবে প্রচুর পরিমাণে?