কলকাতা, ১১ জুন ২০২৫: কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের জন্য অষ্টম কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে উত্তেজনা ও প্রত্যাশা ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই কমিশন গঠনের অনুমোদন দেওয়ার পর থেকেই, প্রায় ৫০ লক্ষ সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগী নতুন বেতন কাঠামো, ভাতা এবং পেনশন সুবিধার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই কমিশনের সুপারিশগুলো ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষক, রেল কর্মী, প্রতিরক্ষা কর্মী, কেরানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরা এই কমিশনের কাছ থেকে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন আশা করছেন।
অষ্টম বেতন কমিশন: প্রেক্ষাপট ও প্রত্যাশা
কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন প্রতি দশ বছর অন্তর গঠিত হয়, যা সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন কাঠামো পর্যালোচনা করে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের ভিত্তিতে সংশোধনের সুপারিশ করে। সপ্তম বেতন কমিশন, যা ২০১৬ সালে কার্যকর হয়েছিল, ন্যূনতম মাসিক বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮,০০০ টাকা করেছিল, যার ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭। এই কমিশনের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে, এবং অষ্টম বেতন কমিশন নতুন কাঠামো প্রণয়নের দায়িত্ব নেবে।
কর্মচারী ইউনিয়নগুলো এবার ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ থেকে ৩.৫-এর মধ্যে নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে, যা বেতন ও পেনশনের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হয়, তাহলে ন্যূনতম মূল বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫১,৪৮০ টাকা হতে পারে, এবং ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা থেকে ২৫,৭৪০ টাকায় উন্নীত হতে পারে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ের পর প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি এতটা উল্লেখযোগ্য নাও হতে পারে।
শিক্ষকদের প্রত্যাশা
কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয় এবং অন্যান্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অষ্টম বেতন কমিশনের কাছ থেকে বেশ কিছু নির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরেছেন। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষকতার পেশাগত দায়িত্ব এবং ক্রমবর্ধমান কাজের চাপ বিবেচনায় তাঁদের বেতন ও ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষ করে, গ্রামীণ এলাকায় কর্মরত শিক্ষকরা গৃহভাড়া ভাতা (এইচআরএ) এবং পরিবহন ভাতা (টিএ) বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন, কারণ তাঁদের প্রায়ই সীমিত সুবিধার মধ্যে কাজ করতে হয়। এছাড়াও, শিক্ষকরা মডিফাইড অ্যাসিওর্ড ক্যারিয়ার প্রোগ্রেশন (এমএসিপি) স্কিমের অধীনে নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
শিক্ষক ইউনিয়নগুলোর মতে, অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশে পারফরম্যান্স-ভিত্তিক প্রণোদনা চালু হতে পারে, যা শিক্ষকদের কাজের গুণগত মান বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে, তাঁরা এও চান যে এই প্রণোদনা ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং ন্যায্য হয়, যাতে কোনো বৈষম্য না হয়।
রেল কর্মীদের আশা
ভারতীয় রেলের লক্ষাধিক কর্মচারী, যাঁরা দেশের পরিবহন ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেন, তাঁরাও অষ্টম বেতন কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছেন। রেল কর্মীদের মধ্যে স্টেশন মাস্টার, টিকিট পরীক্ষক, লোকো পাইলট এবং টেকনিক্যাল স্টাফরা বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য অতিরিক্ত ভাতার দাবি জানিয়েছেন। রেল ইউনিয়নগুলোর দাবি, রাত্রিকালীন ডিউটি এবং দীর্ঘ শিফটের জন্য বিশেষ ভাতা বাড়ানো উচিত।
এছাড়াও, রেল কর্মীরা ইউনিফাইড পেনশন স্কিম (ইউপিএস) নিয়ে উৎসাহী, যা ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এই স্কিমের অধীনে, অবসরের আগের ১২ মাসের গড় বেতনের ভিত্তিতে পেনশন নির্ধারিত হবে, যা পেনশনভোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্য সুবিধা নিয়ে আসবে। রেল কর্মীরা আশা করছেন, অষ্টম বেতন কমিশন এই স্কিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পেনশন কাঠামো আরও উন্নত করবে।
অন্যান্য কর্মচারীদের দাবি
শিক্ষক ও রেল কর্মী ছাড়াও, প্রতিরক্ষা কর্মী, কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের কর্মচারী, পোস্টাল স্টাফ এবং অন্যান্য বিভাগের কর্মীরা অষ্টম বেতন কমিশনের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আশা করছেন। ন্যাশনাল কাউন্সিল–জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (এনসি-জেসিএম) ইতিমধ্যেই একটি ১৩ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে, যারা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ন্যূনতম মজুরি, বেতন স্কেল, ভাতা, পদোন্নতি নীতি এবং পেনশন সুবিধা নিয়ে একটি “কমন মেমোরেন্ডাম” তৈরি করবে। এই কমিটি ২০২৫ সালের জুন মাসে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
কর্মচারীরা মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) বৃদ্ধির জন্যও উৎসুক। বর্তমানে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিএ মূল বেতনের ৫৩% নির্ধারিত হয়েছে, এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এটি ৫৫% হয়েছে। অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশে ডিএ কাঠামো আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও, কর্মচারীরা অন্তর্বর্তী আর্থিক ত্রাণ (ইন্টারিম রিলিফ) চেয়েছেন, যা নতুন কমিশন কার্যকর হওয়ার আগে তাঁদের আর্থিক স্থিতিশীলতা দেবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
অষ্টম বেতন কমিশনের বেতন বৃদ্ধি ও ভাতা সংশোধন সরকারি কর্মচারীদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াবে, যা ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই বলেছেন, “অষ্টম বেতন কমিশনের সিদ্ধান্ত কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং ভোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করবে।” তবে, অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে এই বেতন বৃদ্ধি সরকারের রাজস্ব ব্যয় বাড়াবে, যা রাজকোষীয় ঘাটতির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
পূর্ববর্তী বেতন কমিশনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সাধারণত ২২ মাস সময় লাগে। অষ্টম বেতন কমিশনের ক্ষেত্রেও, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিবেদন জমা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এবং ২০২৬ সালে এটি কার্যকর হবে। তবে, কমিশনের চেয়ারপার্সন ও সদস্য নিয়োগ এবং টার্মস অফ রেফারেন্স (টিওআর) চূড়ান্ত করা এখনও বাকি, যা প্রক্রিয়ায় কিছুটা বিলম্ব ঘটাতে পারে।
ভবিষ্যতের পথ
অষ্টম বেতন কমিশন শিক্ষক, রেল কর্মী, প্রতিরক্ষা কর্মী এবং অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছে। তাঁদের দাবি ও প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি, এই কমিশনকে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে পরামর্শ, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং সময়মতো বাস্তবায়ন এই কমিশনের সাফল্য নির্ধারণ করবে।
শিক্ষকরা শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে, রেল কর্মীরা পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ করতে, এবং অন্যান্য কর্মচারীরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে প্রস্তুত। অষ্টম বেতন কমিশন তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা এখন অপেক্ষায় আছেন সেই দিনের, যখন তাঁদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও জীবনযাত্রার মান নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।