জলঢাকা নদীর ভাঙনে ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় গ্রামবাসীরা

অয়ন দে, কোচবিহার: মেখলিগঞ্জ ব্লকের উছলপুকুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ১৬৮ ধুলিয়া বলদিয়াহাটি গ্রামে জলঢাকা নদীর অব্যাহত ভাঙন (River Erosion in Cooch Behar) গ্রামবাসীদের জীবনে এক…

Allegation of Rigging Amid River Crossing in Nadia, TMC Denies Claims

অয়ন দে, কোচবিহার: মেখলিগঞ্জ ব্লকের উছলপুকুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ১৬৮ ধুলিয়া বলদিয়াহাটি গ্রামে জলঢাকা নদীর অব্যাহত ভাঙন (River Erosion in Cooch Behar) গ্রামবাসীদের জীবনে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। খরস্রোতা জলঢাকা নদী গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রতি বর্ষায় বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন করছে। গত কয়েক বছরে প্রায় ২০০ বিঘা চাষযোগ্য কৃষিজমি নদীর গতিপথে হারিয়ে গেছে, যা এলাকার প্রায় ১৭০টি পরিবারের জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করেছে। প্রশাসনের কাছে বারবার পাথরের বাঁধ নির্মাণের আবেদন জানানো সত্ত্বেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় গ্রামবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা বিরাজ করছে। আসন্ন বর্ষায় গ্রামের ঘরবাড়ি এবং বাকি জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় গ্রামবাসীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

জলঢাকা নদী, যা দক্ষিণ-পূর্ব সিকিমের হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে ভুটান, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা এবং বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলা হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে, এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী। তবে, এই নদীর খরস্রোতা প্রকৃতি এবং অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে ১৬৮ ধুলিয়া বলদিয়াহাটি গ্রামে প্রতি বছর বর্ষায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে চলেছে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, নদীতীরে পাথরের বাঁধ নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আবেদন করা হলেও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে কোনো সমাধান মেলেনি। ফলে, এলাকার কৃষিজমি, ঘরবাড়ি এবং জীবিকা ক্রমশ হুমকির মুখে পড়ছে।

   

স্থানীয় বাসিন্দা রমেশ শুকুল, যিনি ৫০ বিঘা জমি হারিয়েছেন, বলেন, “আমার জীবনের সমস্ত সম্পদ ছিল এই জমি। এখন নদী সব কেড়ে নিয়েছে। প্রশাসনকে বারবার বলেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি।” একইভাবে, চিত্ত বর্মন (২০ বিঘা), কপিলউদ্দীন মিয়া (১০ বিঘা), দফিরুদ্দীন মিয়া (১০ বিঘা), আসের মামুদ (২০ বিঘা) এবং মহেশ্বর বর্মন (২০ বিঘা) সহ অনেক গ্রামবাসী তাদের কৃষিজমি নদীগর্ভে হারিয়েছেন। গ্রামবাসীদের দাবি, এই ক্ষতির তালিকা আরও দীর্ঘ। গত এক দশকে এই জমিগুলো চাষযোগ্য ছিল, যেখানে ধান, পাট, তামাক, আলু এবং শাকসবজির মতো ফসল উৎপন্ন হতো। কিন্তু নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং অব্যাহত ভাঙনের ফলে এই জমিগুলো এখন নদীর তলায়।

গ্রামবাসীদের অভিযোগ, মেখলিগঞ্জের বিধায়ক পরেশ চন্দ্র অধিকারী এবং সাংসদ জয়ন্ত কুমার রায়কে একাধিকবার লিখিতভাবে সমস্যার কথা জানানো হয়েছে। এমনকি, নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরেও অভিযোগ পাঠানো হয়েছে, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা তহিজুল মিয়া বলেন, “আমরা চাই মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে এখানে পাথরের বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করুন। নইলে আমাদের ভিটেমাটি ছাড়া হতে হবে। বর্ষায় গ্রামে কোমর সমান জল দাঁড়ায়, ছোট বাচ্চা আর গবাদি পশু নিয়ে বেঁচে থাকা দায়।” আরেক বাসিন্দা শিবেন্দ্র বর্মন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “ভোটের সময় নেতারা আশ্বাস দেন, কিন্তু কাজের বেলায় কিছুই হয় না। আমাদের গ্রামে না ভালো রাস্তা আছে, না পরিশ্রুত পানীয় জল। এখন ভিটেমাটিও থাকবে কিনা সন্দেহ।”

জলঢাকা নদীর ভাঙন শুধু কৃষিজমির ক্ষতি নয়, গ্রামের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোকেও বিপর্যস্ত করছে। এই গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষির উপর নির্ভরশীল। জমি হারানোর ফলে তাদের জীবিকা চরম সংকটে পড়েছে। অনেকে এখন দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, অন্যরা গ্রাম ছাড়ার কথা ভাবছেন। গ্রামবাসীদের দাবি, প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবিলম্বে পাথরের বাঁধ নির্মাণ করা হলে ভাঙনের তীব্রতা কমানো সম্ভব। এই ধরনের বাঁধ নদীতীর রক্ষা এবং প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Advertisements

জেলা পরিষদের স্থানীয় সদস্য কেশব চন্দ্র বর্মন জানিয়েছেন, “গত বছর আমি ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি বিভিন্ন স্তরে জানানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন দ্রুত সমাধান করা যায়।” তবে, গ্রামবাসীদের মতে, এই ধরনের আশ্বাস তারা বছরের পর বছর শুনে আসছেন, কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। এক্স-এ সাম্প্রতিক পোস্টে এই সমস্যা নিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে তারা প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেছেন।

বন্যা ও নদী ভাঙনের সমস্যা উত্তরবঙ্গের জন্য নতুন নয়। জলঢাকা নদী, যা কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, প্রায়ই বর্ষায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। স্থানীয় পরিবেশবিদরা মনে করেন, নদীশাসন এবং পাথরের বাঁধ নির্মাণের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষার তীব্রতা বৃদ্ধি এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন এই সমস্যাকে আরও জটিল করছে।

গ্রামবাসীদের দাবি, তাদের সমস্যার সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হোক। তারা বলছেন, পাথরের বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি গ্রামে রাস্তাঘাট, পানীয় জল এবং অন্যান্য মৌলিক সুবিধার উন্নতি প্রয়োজন। প্রশাসন যদি এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ১৬৮ ধুলিয়া বলদিয়াহাটি গ্রামের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই ঘটনা কোচবিহারের প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নে অবহেলার একটি প্রকট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামবাসীদের আশা, তাদের কণ্ঠস্বর শুনে প্রশাসন এবার বাস্তব পদক্ষেপ নেবে, যাতে তারা তাদের ভিটেমাটি ও জীবিকা রক্ষা করতে পারে।