কলকাতা থেকে ২০০ কিমির মধ্যে ৭ অপ্রচলিত উইকএন্ড গন্তব্য

কলকাতা (Kolkata) ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী, শুধু তার ঐতিহ্য আর ব্যস্ত জীবনযাত্রার জন্যই নয়, এর আশেপাশের অসংখ্য প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক গন্তব্যের জন্যও পরিচিত। শহরের কোলাহল থেকে…

weekend getaways near kolkata

কলকাতা (Kolkata) ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী, শুধু তার ঐতিহ্য আর ব্যস্ত জীবনযাত্রার জন্যই নয়, এর আশেপাশের অসংখ্য প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক গন্তব্যের জন্যও পরিচিত। শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে এবং প্রকৃতির কোলে দু’দিন কাটাতে চাইলে, কলকাতার ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যা এখনও পর্যটকদের ভিড় থেকে মুক্ত। এই প্রতিবেদনে আমরা সাতটি অপ্রচলিত উইকএন্ড গন্তব্য নিয়ে আলোচনা করব, যা কলকাতাবাসীদের জন্য নিখুঁত পালানোর জায়গা।

১. তাজপুর সমুদ্র সৈকত
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত তাজপুর সমুদ্র সৈকত, কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিমি দূরে। এই সৈকত এখনও বাণিজ্যিকীকরণের ছোঁয়া থেকে মুক্ত, যা এটিকে একটি শান্তিপূর্ণ গন্তব্য করে তুলেছে। ঘন ঝাউ, ইউক্যালিপটাস এবং কাজু গাছের সারি দিয়ে ঘেরা এই সৈকতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো লাল কাঁকড়ার উপস্থিতি, যারা সকালে সৈকতে ঘুরে বেড়ায়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য এখানে অপূর্ব। পর্যটকরা এখানে হ্যামকে শুয়ে সমুদ্রের শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে পারেন বা স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে দিঘা পৌঁছে সেখান থেকে অটোরিকশায় তাজপুর যাওয়া যায়।

   

২. পিয়ালি দ্বীপ
কলকাতা থেকে মাত্র ৭২ কিমি দূরে অবস্থিত পিয়ালি দ্বীপ একটি প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য। মাতলা ও পিয়ালি নদীর সঙ্গমে অবস্থিত এই দ্বীপ সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। এখানকার ম্যানগ্রোভ বন, পাখির কিচিরমিচির এবং শান্ত পরিবেশ মনকে প্রশান্তি দেয়। পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য এটি একটি দুর্দান্ত স্থান, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। পিয়ালি নদীতে বোটিং করা এখানকার আরেকটি আকর্ষণ। স্থানীয় রিসর্টে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, এবং এটি একটি পিকনিক স্পট হিসেবেও জনপ্রিয়।

৩. জয়পুল
বারাসাত থেকে মাত্র ১৩ কিমি দূরে অবস্থিত জয়পুল একটি শান্ত গ্রামীণ গন্তব্য। কলকাতা থেকে প্রায় ৪৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি তার সবুজ প্রকৃতি এবং শান্ত পরিবেশের জন্য পরিচিত। এখানে আপনি ধানখেত, পুকুর এবং গ্রামীণ জীবনের সরলতা উপভোগ করতে পারেন। জয়পুলে ফার্মহাউসে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে শান্তিপূর্ণ সময় কাটানো যায়। এটি শহরের কোলাহল থেকে দূরে একটি নিরিবিলি ছুটির জন্য উপযুক্ত।

৪. মাছরাঙা দ্বীপ
কলকাতা থেকে ৯১ কিমি দূরে অবস্থিত মাছরাঙা দ্বীপ একটি অপ্রচলিত গন্তব্য, যা সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থিত। এই দ্বীপটি তার নির্মল সৈকত এবং ম্যানগ্রোভ বনের জন্য পরিচিত। এখানে আপনি শান্ত পরিবেশে সময় কাটাতে পারেন এবং স্থানীয় জেলেদের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। সূর্যাস্তের সময় এখানকার দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। মাছরাঙা দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য কলকাতা থেকে নামখানা পর্যন্ত ট্রেন বা বাসে যাওয়া যায়, এবং সেখান থেকে ফেরিতে করে দ্বীপে পৌঁছানো যায়।

৫. সিঙ্গি
কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দূরে অবস্থিত সিঙ্গি একটি শান্ত গ্রাম, যা তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের জন্য পরিচিত। এই গ্রামটি মহাভারতের বাংলা অনুবাদক কাশীরাম দাসের জন্মস্থান। সবুজ ধানখেত এবং ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রামটি প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য আদর্শ। এখানে আপনি গ্রামের শান্ত পরিবেশে হাঁটতে পারেন এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারেন। সিঙ্গিতে থাকার জন্য ছোট ছোট গেস্টহাউস রয়েছে, যা বাজেট-বান্ধব।

Advertisements

৬. গালুডিহ
কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০ কিমি দূরে অবস্থিত গালুডিহ একটি প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য অফবিট গন্তব্য। ঘাটশিলা থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত এই জায়গাটি তার অস্পৃশ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। পাহাড়, জঙ্গল এবং সুবর্ণরেখা নদীর সান্নিধ্য এই স্থানকে বিশেষ করে তোলে। এখানে আপনি পাখি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, হিলটপ বাংলোতে থাকতে পারেন এবং কাছাকাছি রত্মোহনা বা প্রাচীন মন্দির পরিদর্শন করতে পারেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘাটশিলা পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে গালুডিহ যাওয়া যায়।

৭. বাবুরভানি
কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০ কিমি দূরে অবস্থিত বাবুরভানি একটি ছোট্ট গ্রাম, যা সুবর্ণরেখা নদীর তীরে অবস্থিত। এই গ্রামটি তার জঙ্গল, কাজু বাগান এবং ধানখেতের জন্য পরিচিত। এখানে আপনি শান্ত পরিবেশে সময় কাটাতে পারেন এবং স্থানীয় গ্রামীণ জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হতে পারেন। বাবুরভানিতে থাকার জন্য ছোট ছোট রিসর্ট এবং গেস্টহাউস রয়েছে, যা প্রকৃতির কোলে একটি আরামদায়ক অভিজ্ঞতা দেয়। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঘাটশিলা পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতে এই গ্রামে যাওয়া যায়।

কেন এই গন্তব্যগুলি বেছে নেবেন?
এই সাতটি গন্তব্য কলকাতার কাছাকাছি অবস্থিত এবং সহজেই সড়ক বা রেলপথে পৌঁছানো যায়। এগুলি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র যেমন দিঘা বা মন্দারমণির মতো ভিড়ে ভরা নয়, তাই শান্তি ও প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিজ্ঞতা দেয়। এই জায়গাগুলি বাজেট-বান্ধব, এবং এখানে থাকার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের রিসর্ট, গেস্টহাউস বা ফার্মহাউস পাওয়া যায়। প্রকৃতি প্রেমী, পাখি পর্যবেক্ষক বা শান্তির খোঁজে থাকা পর্যটকদের জন্য এই গন্তব্যগুলি আদর্শ।

ভ্রমণের পরামর্শ
• আগাম পরিকল্পনা: সপ্তাহান্তে এই জায়গাগুলিতে ভিড় কম হলেও, থাকার জায়গা আগে থেকে বুক করে নেওয়া ভালো।
• যাতায়াত: কলকাতা থেকে এই গন্তব্যগুলিতে ট্রেন বা গাড়িতে সহজেই পৌঁছানো যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাস বা অটোরিকশা পাওয়া যায়।
• সেরা সময়: অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এই জায়গাগুলি পরিদর্শনের জন্য আদর্শ সময়, কারণ আবহাওয়া তখন মনোরম থাকে।
• প্রয়োজনীয় জিনিস: আরামদায়ক জুতো, হালকা জামাকাপড়, এবং পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য বাইনোকুলার সঙ্গে রাখুন।

কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে এই অপ্রচলিত গন্তব্যগুলি আপনাকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাবে। তাজপুরের শান্ত সৈকত থেকে শুরু করে সিঙ্গির ঐতিহাসিক গ্রামীণ পরিবেশ—প্রতিটি জায়গাই একটি অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এই গন্তব্যগুলি শুধুমাত্র শান্তি ও প্রকৃতির সৌন্দর্যই দেয় না, বরং বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই, আগামী সপ্তাহান্তে ব্যাগ গুছিয়ে এই অপ্রচলিত গন্তব্যগুলির একটিতে ঘুরে আসুন এবং শহরের কোলাহল ভুলে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যান।