ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক (India-Pakistan Conflict) উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর জবাবে পাকিস্তান তাদের ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ শুরু করেছে, যা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতাকে আরও তীব্র করেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দাবি করেছে, ভারত তাদের তিনটি বিমানঘাঁটি—রাওয়ালপিন্ডির নূর খান, শরকোটের রফিকি এবং মুরিদ বিমানঘাঁটি—লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে পাকিস্তান ভারতের পাঠানকোট, উধমপুর এবং জম্মুসহ বিভিন্ন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এই পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় দেশই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির দাবি করছে, যদিও স্বাধীনভাবে এসব দাবি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
শ্রীনগর থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানিয়েছেন, শনিবার ভোর পৌনে ছয়টার দিকে শহরে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। শ্রীনগরে পুরোপুরি ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়েছে, এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে বলে পাকিস্তানের সংবাদদাতারা জানিয়েছেন। পাকিস্তানের সেনা মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী দাবি করেছেন, ভারতের হামলা সত্ত্বেও তাদের বিমানবাহিনীর কোনো সম্পদের ক্ষতি হয়নি। তবে, রাওয়ালপিন্ডির ডেপুটি কমিশনার স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ির আলো নিভিয়ে রাখতে এবং অযথা বাইরে না বেরোনোর নির্দেশ দিয়েছেন।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার নিশিরাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ২৬টি স্থানে সন্দেহভাজন সশস্ত্র ড্রোন দেখা গেছে। এই ড্রোনগুলো বারামুল্লা, শ্রীনগর, জম্মু, পাঠানকোট, ফিরোজপুর, জয়সলমীর, ভুজসহ বিভিন্ন বেসামরিক ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার চেষ্টা করেছিল। ফিরোজপুরের একটি বেসামরিক এলাকায় এমনই একটি ড্রোন হামলায় বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, এবং নিরাপত্তা বাহিনী এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছে। ভারতের এস-৪০০ বিমান-বিধ্বংসী মিসাইল সিস্টেম এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই হামলাগুলো ব্যর্থ করেছে।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ভারত তাদের তিনটি বিমানঘাঁটিতে শনিবার ভোররাতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। নূর খান বিমানঘাঁটি, যা ইসলামাবাদের কাছে অবস্থিত এবং পাকিস্তানের সামরিক সদর দফতরের সন্নিকটে, একটি উচ্চ নিরাপত্তা সম্পন্ন ঘাঁটি। মুরিদ বিমানঘাঁটি পাকিস্তানের ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, এবং রফিকি বিমানঘাঁটি জেএফ-১৭ ও মিরাজ যুদ্ধবিমানের আধার। ভারতের এই হামলা পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হানার প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক হামলায় ভারতের জম্মু, পাঠানকোট এবং উধমপুরে সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করা হয়েছে। শ্রীনগর ও আশপাশের এলাকায় ভারী সামরিক সংঘর্ষ চলছে, এবং ভারতীয় বাহিনী সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম সক্রিয় করেছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ৩২টি বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং পাকিস্তান তাদের আকাশসীমা শনিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে।
এই সংঘাতের পটভূমি হলো গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলা, যেখানে ২৬ জন, বেশিরভাগই পর্যটক, নিহত হয়েছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদকে দায়ী করেছে। এর জবাবে ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরিচালনা করে, যেখানে পাকিস্তান ও পিওকে-র নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে নির্ভুল হামলা চালানো হয়। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দাবি করেছেন, এই হামলায় ১০০ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।
পাকিস্তান অবশ্য দাবি করেছে, ভারতের হামলায় ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, এবং মসজিদের মতো বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এই হামলাকে “কাপুরুষোচিত” এবং “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর জবাবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ শুরু করে, যার অধীনে তারা ভারতের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে।
করাচিতেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। ফয়সাল হাইওয়ে এবং গুলিস্তান-ই-জওহার এলাকায় ভোরবেলা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, এবং আকাশে আলোর ঝলকানি দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে আলো নিভিয়ে বাড়ির ভেতরে অবস্থান করছেন। করাচি বিমানবন্দরের দিক থেকেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে, তবে প্রশাসন এখনও এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শন এবং দ্রুত ডি-এস্কেলেশনের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “বিশ্ব দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত বহন করতে পারে না।” চীন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাজ্যও উভয় দেশকে সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার আহ্বান জানিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি বলেছেন, “পাকিস্তানের পাহালগাম হামলার মাধ্যমে এই সংঘাতের সূচনা হয়েছে, এবং ভারত কেবল তার জবাব দিয়েছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, ভারতের গোয়েন্দা তথ্যে জানা গিয়েছিল যে পাকিস্তান থেকে আরও হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, যার প্রতিরোধে ‘অপারেশন সিঁদুর’ অপরিহার্য ছিল।
এই সংঘাতের ফলে উভয় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং গুজরাটে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের ৩২টি বিমানবন্দরে বেসামরিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে, এবং পাকিস্তানের আকাশসীমাও সাময়িকভাবে বন্ধ। সীমান্ত এলাকায় ব্ল্যাকআউট এবং সাইরেনের শব্দে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের এই সংঘাতের পেছনে দীর্ঘদিনের কাশ্মীর বিরোধ একটি প্রধান কারণ। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। উভয় দেশই কাশ্মীরের পূর্ণ দাবি করে, তবে প্রত্যেকে এর একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, যেখানে ভারত দাবি করে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উভয় দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা এই সংঘাতকে বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক করে তুলেছে। ভারতের কাছে প্রায় ১৭২টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। যেকোনো ভুল গণনা বা এস্কেলেশন বড় ধরনের সংঘাতের কারণ হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং উভয় দেশের সংযম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ উভয়ই একে অপরের প্রতি শক্তি প্রদর্শনের প্রচেষ্টা। তবে, পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত এড়াতে সংলাপ এবং কূটনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য শক্তিগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা এই সংকট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।