ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে অমিত শাহ-জলশক্তি মন্ত্রীর বৈঠক

গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় এক ভয়াবহ জঙ্গি (Pahalgam Terror Attack) হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই ঘটনার পর…

Pahalgam Terror Attack

গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় এক ভয়াবহ জঙ্গি (Pahalgam Terror Attack) হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই ঘটনার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে, যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই ঘটনার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-সহ শীর্ষ নেতৃত্ব উচ্চ পর্যায়ের একাধিক বৈঠক করেছেন। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) ঘটনাস্থলে পৌঁছে অপরাধের দৃশ্য পুনর্গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে। এদিকে, পাকিস্তান টানা ষষ্ঠ রাতে নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলওসি) যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, যার জবাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী তৎক্ষণাৎ পাল্টা হামলা চালিয়েছে।

এনআইএ-র তদন্ত ও অপরাধের দৃশ্য পুনর্গঠন

এনআইএ-র একটি দল বাইসারান উপত্যকায় পৌঁছে ঘটনার তদন্তে নেমেছে। সূত্রের খবর, হামলাকারীরা পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এনআইএ সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানের কুপওয়ারায় অবস্থিত লস্কর-ই-তৈবার শীর্ষ কমান্ডার ফারুক আহমেদ এই হামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হামলায় জড়িত দুই পাকিস্তানি জঙ্গির নাম আলি ভাই ওরফে তালহা এবং হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় লস্কর নিয়োগপ্রাপ্ত আদিল হুসেন থোকার নামও তৃতীয় হামলাকারী হিসেবে উঠে এসেছে। এনআইএ ঘটনাস্থলে অপরাধের দৃশ্য পুনর্গঠন করে হামলার পরিকল্পনা ও সম্পাদনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছে। সূত্রের খবর, হামলাকারীরা হামলার এক সপ্তাহ আগে থেকেই পহেলগাঁওয়ের জঙ্গলে ছিল এবং বেটাব উপত্যকার পরিবর্তে বাইসারানকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়, কারণ এখান থেকে পালানো সহজ ছিল।

   

উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ও প্রতিশোধের পরিকল্পনা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই হামলার পর থেকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বুধবার তিনি দিল্লিতে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস)-এর দ্বিতীয় বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। এই বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল উপস্থিত ছিলেন। সিসিএস জম্মু ও কাশ্মীরের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে আলোচনা করে। মোদি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিশোধের সময়, লক্ষ্য এবং পদ্ধতি নির্ধারণে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এছাড়া, ক্যাবিনেট কমিটি অন পলিটিকাল অ্যাফেয়ার্স (সিসিপিএ) এবং ইউনিয়ন ক্যাবিনেটের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিসিপিএ-এর এই বৈঠক ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর থেকে প্রথম, যেখানে ভারত পাকিস্তানের ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশন’ মর্যাদা প্রত্যাহার এবং বালাকোট বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ভারতের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ

হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি স্থগিত করা হয়েছে, যা পাকিস্তানের জল নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল, অটারি সীমান্ত বন্ধ এবং দূতাবাসের কর্মী সংখ্যা হ্রাস করা হয়েছে। পাকিস্তান এই পদক্ষেপের প্রতিবাদে ভারতীয় বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ভারতের যেকোনো হামলাকে ‘যুদ্ধের কাজ’ হিসেবে বিবেচনা করার হুমকি দিয়েছেন।

নিয়ন্ত্রণ রেখায় উত্তেজনা

পাকিস্তান গত ছয় দিন ধরে নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে চলেছে। কুপওয়ারা, বারামুল্লা, পুঞ্চ এবং আখনুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অকারণে গুলি চালিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতিটি ঘটনায় দৃঢ়ভাবে জবাব দিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক অপারেশনের মহাপরিচালকরা হটলাইনে কথা বলেছেন, যেখানে ভারত পাকিস্তানকে এই লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য সতর্ক করেছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিরোধী দলের নেতারা, যার মধ্যে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে এবং সাংসদ রাহুল গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বিশেষ সংসদীয় অধিবেশন আহ্বানের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা জাতীয় ঐক্য প্রদর্শন এবং পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য এই পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। রাজ্যসভার সাংসদ কপিল সিবালও একই দাবি জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং প্যালেস্টাইন-সহ বিভিন্ন দেশ এই হামলার নিন্দা করেছে এবং ভারতের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেছেন, তারা ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

পহেলগাঁও হামলা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত সরকার এই হামলার জবাবে কঠোর এবং কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের প্রতিক্রিয়া সীমিত এবং সুনির্দিষ্ট হবে, যাতে পূর্ণ-মাত্রার যুদ্ধ এড়ানো যায়। এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকে আরও একবার সামনে এনেছে।