পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে সর্বদলীয় বৈঠকে ঐক্যের বার্তা সরকারের

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২০২৫) সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলার (Pahalgam Terror Attack) পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে একটি সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজন করে।…

Government Convenes All-Party Meeting to Brief Leaders on Pahalgam Terror Attack

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২০২৫) সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলার (Pahalgam Terror Attack) পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে একটি সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজন করে। এই বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের হামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয় এবং তাঁদের মতামত শোনা হয়। বৈঠকের শুরুতে হামলায় নিহত ২৬ জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক।

   

সর্বদলীয় বৈঠকের বিবরণ

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ এবং সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। এছাড়াও, রাজ্যসভার সভাপতি জে পি নাড্ডা, রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়গে এবং লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্যান্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন এনসিপি-এসপি-র সুপ্রিয়া সুলে, এনসিপি-র প্রফুল প্যাটেল, এআইএমআইএম-এর আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, বিজেডি-র সস্মিত পাত্র, ওয়াইএসআরসিপি-র লাভু শ্রী কৃষ্ণ দেবরায়ালু, শিবসেনার শ্রীকান্ত শিন্ডে, এএপি-র সঞ্জয় সিং, টিএমসি-র সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, আরজেডি-র প্রেমচাঁদ গুপ্তা, ডিএমকে-র টি শিবা এবং এসপি-র রাম গোপাল যাদব।

বৈঠকটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুতর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজিত হয়, যা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা বা ২০২০ সালের ভারত-চিন সীমান্ত সংঘাতের সময়ও দেখা গিয়েছিল। এই ধরনের বৈঠক জাতীয় ঐক্যের বার্তা দেয় এবং বিরোধী দলগুলিকে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ দেয়, পাশাপাশি তাঁদের মতামত প্রকাশের সুযোগ প্রদান করে।

পহেলগাঁও হামলা ও সরকারের পদক্ষেপ

মঙ্গলবার দুপুরে পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় পাঁচ থেকে ছয়জন জঙ্গি পর্যটকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হন। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (TRF), যিনি পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা।

হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (CCS)-এর বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে:

• সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত: ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে, যতক্ষণ না পাকিস্তান সীমান্তবর্তী সন্ত্রাসবাদের সমর্থন বন্ধ করে।
• অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ: এই গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত চেকপোস্ট তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমোদন নিয়ে পারাপারকারীদের ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে ফিরতে হবে।
• SAARC ভিসা স্কিম বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা ছাড় স্কিম বাতিল করা হয়েছে। ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে।
• কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস: পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
• হাইকমিশনের কর্মী হ্রাস: উভয় দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে, যা ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে কার্যকর হবে।

Advertisements

সর্বদলীয় বৈঠকের তাৎপর্য

সর্বদলীয় বৈঠকটি সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার প্রয়াস। টিএমসি নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বৈঠকে নিরাপত্তা ত্রুটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সমস্ত দল সরকারের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একমত। বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী বৈঠকের পর জানিয়েছেন, তিনি জম্মু ও কাশ্মীর সফর করবেন এবং কেন্দ্রের পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, দলটি আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে এই বৈঠকের সভাপতিত্ব করবেন, কারণ এটি জাতির মেজাজ এবং ঘটনার গুরুত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো। তবে, রাজনাথ সিং-এর নেতৃত্বে বৈঠকটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এবং নেতারা হামলার নিন্দা জানিয়ে কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (NSC) বৃহস্পতিবার একটি জরুরি বৈঠক করে। পাকিস্তান ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য তাদের আকাশপথ বন্ধ করেছে এবং ভারতের সঙ্গে সব বাণিজ্য স্থগিত করেছে।

জনমত ও প্রভাব

পহেলগাঁও হামলা দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় হোটেল মালিক এবং দোকানদাররা হামলার বিরুদ্ধে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। পর্যটন শিল্পের উপর এই হামলার গভীর প্রভাব পড়েছে, কারণ পহেলগাঁও ছিল পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই ঘটনা তাদের জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারগুলিকে কাশ্মীরিদের হয়রানি থেকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সর্বদলীয় বৈঠকটি সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সরকার এবং বিরোধী দলগুলির একযোগে নিন্দা এবং কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করে। তবে, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণ এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।