২৬/১১ মামলায় অভিযুক্ত রানা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চান

২৬/১১ মুম্বাই জঙ্গি হামলার অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানা (Tahawwur Rana) তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চেয়ে দিল্লির একটি আদালতে আবেদন করেছেন। ৬৪…

6/11 Accused Tahawwur Rana Seeks Court Nod to Speak With Family During Custody

২৬/১১ মুম্বাই জঙ্গি হামলার অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানা (Tahawwur Rana) তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চেয়ে দিল্লির একটি আদালতে আবেদন করেছেন। ৬৪ বছর বয়সী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান ব্যবসায়ী রানা গত ১৯ এপ্রিল তার আইনজীবীর মাধ্যমে বিশেষ বিচারক হরদীপ কৌরের কাছে এই আবেদন জমা দেন। সোমবার, ২১ এপ্রিল, বিচারক জাতীয় তদন্ত সংস্থাকে (এনআইএ) এই আবেদনের জবাব দিতে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।

গত ১০ এপ্রিল, দিল্লির পটিয়ালা হাউস আদালত রানাকে ১৮ দিনের এনআইএ হেফাজতে পাঠায়। তিনি মুম্বাই হামলার মূল ষড়যন্ত্রকারী ডেভিড কোলম্যান হেডলির (ওরফে দাউদ গিলানি) ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এনআইএ অভিযোগ করেছে যে, ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হেডলি ভারতে আসার আগে রানার সঙ্গে পুরো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রেখে হেডলি রানাকে একটি ইমেল পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার সম্পত্তি ও জিনিসপত্রের বিবরণ ছিল। এছাড়া, হেডলি রানাকে পাকিস্তানি নাগরিক ইলিয়াস কাশ্মিরি এবং আব্দুর রেহমানের জড়িত থাকার কথাও জানিয়েছিলেন, যারা এই মামলায় অভিযুক্ত।

   

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর, পাকিস্তানের ১০ জন জঙ্গি আরব সাগরের সমুদ্রপথে মুম্বাইয়ে প্রবেশ করে একটি রেলওয়ে স্টেশন, দুটি বিলাসবহুল হোটেল এবং একটি ইহুদি কেন্দ্রে সমন্বিত হামলা চালায়। প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে চলা এই হামলায় ১৬৬ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। এই হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি)।

তাহাউর রানা, যিনি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরে কানাডার নাগরিকত্ব নেন, ২০০৫ সাল থেকে এই হামলার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে এনআইএ অভিযোগ করেছে। তিনি হেডলিকে ভারতে ভিসা পেতে এবং মুম্বাইয়ে ‘ইমিগ্রান্ট ল’ সেন্টার’ নামে একটি ফ্রন্ট অফিস স্থাপন করতে সহায়তা করেছিলেন, যা হামলার জন্য গোয়েন্দা সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই অফিসের মাধ্যমে হেডলি মুম্বাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর রেকি করেন।

রানার প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং জটিল ছিল। ২০০৯ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০১১ সালে তিনি এলইটি-কে সমর্থন দেওয়া এবং ডেনমার্কের একটি সংবাদপত্রে হামলার পরিকল্পনার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। তবে, মুম্বাই হামলায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পান। ২০১৩ সালে তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু ২০২০ সালে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যগত কারণে মুক্তি দেওয়া হয়। একই বছর ভারত তার প্রত্যর্পণের আবেদন জানায়, এবং ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত এটি অনুমোদন করে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর প্রত্যর্পণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। ৪ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট রানার প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে তার রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেয়।

১০ এপ্রিল ভারতে পৌঁছানোর পর রানাকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পটিয়ালা হাউস আদালতে হাজির করা হয়। এনআইএ তাকে ২০ দিনের হেফাজতের জন্য আবেদন করেছিল, কিন্তু বিচারক চন্দর জিত সিং ১৮ দিনের হেফাজত মঞ্জুর করেন। আদালত নির্দেশ দেয় যে, রানার প্রতি ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসা পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রতি দুই দিন পর তার আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হবে।

এনআইএ আদালতে জানিয়েছে যে, তারা রানার জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে মুম্বাই হামলার পূর্ণ ষড়যন্ত্র উন্মোচন করতে চায়। সংস্থাটি সন্দেহ করে যে, রানা মুম্বাইয়ের মতো একই ধরনের জঙ্গি হামলা ভারতের অন্য শহরগুলোতেও পরিকল্পনা করেছিলেন। এই তদন্তের জন্য রানাকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে, যাতে ঘটনার পুনর্গঠন করে জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে গভীর তথ্য পাওয়া যায়।

Advertisements

রানার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি (ফৌজদারি ষড়যন্ত্র), ১২১ (যুদ্ধ ঘোষণা), ১২১এ (যুদ্ধের ষড়যন্ত্র), ৩০২ (খুন), ৪৬৮ ও ৪৭১ (জালিয়াতি) ধারা এবং বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের (ইউএপিএ) ১৮ ও ২০ ধারার অধীনে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগগুলোর মধ্যে জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য।

রানার এই আবেদন ভারতের বিচার ব্যবস্থায় মানবিক দিকটি তুলে ধরেছে। তিনি যদিও গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি, তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি চাওয়া তার মৌলিক অধিকারের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আদালত এই আবেদনের বিষয়ে এনআইএ-র জবাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এই প্রত্যর্পণ এবং বিচার প্রক্রিয়া ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মুম্বাই হামলার পর ১৬ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, এই ঘটনা ভারতীয়দের মনে গভীর ক্ষত রেখে গেছে। রানার প্রত্যর্পণ এবং তার বিচার শুধুমাত্র ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে না, বরং পাকিস্তানের জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং তাদের বাহ্যিক সমর্থনের বিষয়ে নতুন তথ্য উন্মোচন করতে পারে।

এনআইএ-র তদন্তে রানার ভূমিকা এবং তার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য ব্যক্তিদের বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশ পেতে পারে। তাকে দিল্লির তিহার জেলের উচ্চ-নিরাপত্তা সেলে রাখা হতে পারে, এবং তার জিজ্ঞাসাবাদে এনআইএ-র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত থাকবেন। এই মামলার বিচার ভারতের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে, এবং এটি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।