পশ্চিমবঙ্গে সংশোধিত ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় সংঘটিত সহিংসতা (Bengal Violence) নিয়ে বাংলাদেশের মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত। শুক্রবার ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় (এমইএ) এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মন্তব্যকে “অপ্রয়োজনীয় এবং ভিত্তিহীন” বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশকে নিজের সীমানার মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এই জবাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতি আহ্বানের প্রেক্ষাপটে এসেছে।
ভারতের অবস্থান
বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “পশ্চিমবঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের মন্তব্য আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। এটি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর চলমান নির্যাতন নিয়ে ভারতের উদ্বেগের সঙ্গে সমান্তরাল টানার একটি স্পষ্ট এবং অসৎ চেষ্টা।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য ও নৈতিকতার প্রদর্শনের পরিবর্তে বাংলাদেশের উচিত নিজের দেশের সংখ্যালশুদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগ দেওয়া।” এই বিবৃতি বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে, যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ভারতকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতার প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙরে ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় গত ১১ ও ১২ এপ্রিল সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় এবং পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই সহিংসতায় অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমএইচএ) মঙ্গলবার মুর্শিদাবাদের তিনটি সীমান্ত এলাকায় সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অতিরিক্ত আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয়। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এই সহিংসতায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের সম্পৃক্ততা ছিল, যাদের স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা সমর্থন করেছিলেন বলে অভিযোগ। তবে, এই নেতারা পরে এই উপাদানগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি ইউনিট দাবি করেছে যে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান শহরে “৪০০-এর বেশি হিন্দু” তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যবস্তু সহিংসতা চালানো হয়েছে। এই দাবি সহিংসতার তীব্রতা এবং এর সাম্প্রদায়িক প্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন
ভারত বারবার বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত বছর ভারত বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র এবং চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক ধামের প্রধান চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীতে জামিন অস্বীকারের ঘটনায় “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করেছিল। বিদেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “এই ঘটনা বাংলাদেশে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর একাধিক হামলার ধারাবাহিকতা। আগুন দেওয়া, সংখ্যালঘুদের বাড়ি ও ব্যবসা লুটপাট, চুরি, ভাঙচুর এবং মন্দির ও দেবতার অবমাননার ঘটনাগুলি গভীরভাবে উদ্বেগজনক।”
মন্ত্রণালয় আরও উল্লেখ করেছে যে এই হামলার অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ শান্তিপূর্ণভাবে বৈধ দাবি উত্থাপনকারী একজন ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার অভিযোগকে “দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান” করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা মুসলিমদের উপর হামলার নিন্দা জানাই, যা জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমরা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গকে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সকল পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাই।”
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
এই ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি সংবেদনশীল সময়ে ঘটেছে। ভারত বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদী বক্তৃতা, সহিংসতা এবং উস্কানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ২৯ নভেম্বর ২০২৪-এ বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “ভারত ধারাবাহিকভাবে এবং দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর হুমকি ও লক্ষ্যবস্তু হামলার বিষয়টি উত্থাপন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এর দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ বিল নিয়ে সহিংসতা এবং বাংলাদেশের মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ভারতের কড়া জবাব বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে তার দীর্ঘদিনের উদ্বেগের প্রতিফলন। পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তদন্তের মাধ্যমে পরিষ্কার হবে। এই ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিয়ে পারস্পরিক উদ্বেগ এবং দায়িত্বশীল আচরণের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতে উভয় দেশকে কূটনৈতিকভাবে এই বিষয়গুলি সমাধান করতে হবে, যাতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সম্প্রীতি বজায় থাকে।