২০২৪-২৫ আর্থিকবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে ১৮ কোটির বেশি পর্যটকের আমদানি!

পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) পর্যটন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন সোমবার বিধানসভায় জানিয়েছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ১৮ কোটিরও বেশি পর্যটক এসেছেন। এই সংখ্যা দুই অর্থবছর আগের…

Tourists in West Bengal

পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) পর্যটন মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন সোমবার বিধানসভায় জানিয়েছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ১৮ কোটিরও বেশি পর্যটক এসেছেন। এই সংখ্যা দুই অর্থবছর আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। মন্ত্রী এই পর্যটকদের পদচারণার এই অভূতপূর্ব বৃদ্ধির জন্য নতুন পর্যটন স্থানের উন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধার উন্নতিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “প্রতিটি স্থানের নিজস্ব একটি অনন্য পরিচয় রয়েছে এবং আমরা সেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে তার পর্যটন প্রোফাইল তুলে ধরছি।”

short-samachar

   

এই ঘোষণা পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্পের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাজ্যের পর্যটন খাত গত কয়েক বছরে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, এবং এই সংখ্যা তারই প্রমাণ। পর্যটন মন্ত্রী বিধানসভায় তার বক্তৃতায় জানান, পর্যটনের এই উত্থান শুধুমাত্র রাজ্যের অর্থনীতির জন্যই নয়, স্থানীয় জনগণের জীবিকার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

পর্যটন বৃদ্ধির কারণ
ইন্দ্রনীল সেন জানান, গত দুই বছরে রাজ্য সরকার পর্যটনের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়েছে। দার্জিলিং-এর পাহাড়ি সৌন্দর্য থেকে শুরু করে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, দিঘার সমুদ্র সৈকত থেকে শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—প্রতিটি স্থানে পর্যটকদের জন্য নতুন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। “আমরা নতুন পর্যটন স্পট চিহ্নিত করেছি এবং সেখানে রাস্তাঘাট, হোটেল, পরিবহন এবং পরিচ্ছন্নতার মতো মৌলিক সুবিধা গড়ে তুলেছি,” তিনি বলেন।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, পুরুলিয়ার আয়োডা পাহাড়, দুয়ার্সের চা বাগান, এবং মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলি পর্যটকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়া, দার্জিলিং-এর টয় ট্রেন এবং কলকাতার হাওড়া ব্রিজের মতো আইকনিক স্থানগুলি পর্যটকদের কাছে সবসময়ই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

পরিসংখ্যানের তুলনা
মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পশ্চিমবঙ্গে পর্যটক সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটির কাছাকাছি। সেই তুলনায় ২০২৪-২৫ সালে ১৮ কোটিরও বেশি পর্যটকের আগমন একটি বিশাল লাফ। এই বৃদ্ধি কেবলমাত্র পর্যটক সংখ্যার দিক থেকেই নয়, রাজ্যের পর্যটন থেকে আয়ের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই বছরে পর্যটন থেকে আয় গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি হতে পারে।

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৪ মিলিয়ন (২.৪ কোটি), এবং বিদেশি পর্যটক ছিল ৩৪ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু ২০২৪-২৫ সালে এই সংখ্যা লাফিয়ে ১৮ কোটি ছাড়িয়েছে, যা দেশীয় এবং বিদেশি পর্যটকদের সম্মিলিত আগমনের ফল। মন্ত্রী জানান, কোভিড-পরবর্তী সময়ে পর্যটন শিল্পে পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি নতুন গন্তব্যের উত্থান এই সাফল্যের অন্যতম কারণ।

পর্যটন উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগ
ইন্দ্রনীল সেন জানান, রাজ্য সরকার পর্যটনকে অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্দরবনে ইকো-ট্যুরিজম বাড়ানোর জন্য নতুন নৌকা ও গাইড সুবিধা চালু করা হয়েছে। দার্জিলিং এবং কালিম্পং-এ হোমস্টে পরিষেবা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা স্থানীয়দের জন্য আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে। এছাড়া, শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সাংস্কৃতিক পর্যটনের প্রচারে নতুন উৎসব ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে।

মন্ত্রী বলেন, “আমরা প্রতিটি স্থানের পরিচয় বজায় রেখে তার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি।” এর ফলে পর্যটকরা কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, স্থানীয় খাবার, হস্তশিল্প এবং ঐতিহ্যের স্বাদও গ্রহণ করতে পারছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে টেরাকোটার মন্দির এবং বালুচরী শাড়ির জনপ্রিয়তা পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।

অর্থনীতিতে প্রভাব
পর্যটনের এই বৃদ্ধি রাজ্যের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন এবং হস্তশিল্প শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, পর্যটকদের আগমনে তাদের আয় দ্বিগুণ হয়েছে। একজন দার্জিলিং-এর চা বিক্রেতা বলেন, “এই বছর পর্যটকদের ভিড়ে আমার বিক্রি অনেক বেড়েছে।” একইভাবে, দিঘার এক হোটেল মালিক বলেন, “গত দুই বছরের তুলনায় এবার আমাদের রুম সবসময় বুকড থাকছে।”

পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিটিডিসি) জানিয়েছে, তারা নতুন প্যাকেজ এবং প্রচারণার মাধ্যমে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। এছাড়া, রাজ্যের বাজেটে পর্যটনের জন্য বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে পর্যটনের জন্য ৩০৪৬৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।

জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
মন্ত্রীর এই ঘোষণার পর সাধারণ মানুষ ও পর্যটন বিশেষজ্ঞরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একজন কলকাতার বাসিন্দা বলেন, “পর্যটন বাড়লে আমাদের রাজ্যের সৌন্দর্য বিশ্বের কাছে পৌঁছাবে। এটা আমাদের জন্য গর্বের।” একজন পর্যটন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, “১৮ কোটি পর্যটকের এই সংখ্যা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। এটি পশ্চিমবঙ্গকে পর্যটনের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে নিয়ে যেতে পারে।”

তবে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। পর্যটকদের ভিড় বাড়ার সঙ্গে পরিবেশ দূষণ এবং অবকাঠামোর উপর চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই পর্যটনের জন্য পরিকল্পনা জরুরি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইন্দ্রনীল সেন জানান, সরকারের লক্ষ্য হল পর্যটনকে আরও সমৃদ্ধ করা। “আমরা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে নতুন প্রচারণা শুরু করছি। এছাড়া, গ্রামীণ পর্যটন এবং ইকো-ট্যুরিজমের উপর জোর দেওয়া হবে,” তিনি বলেন। রাজ্যের পর্যটন নীতিতে স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থান এবং পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে।

২০২৪-২৫ সালে ১৮ কোটির বেশি পর্যটকের আগমন পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের জন্য একটি বড় সাফল্য। ইন্দ্রনীল সেনের নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টা এই খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই বৃদ্ধি কেবল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে না, রাজ্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। তবে, এই সাফল্যকে টেকসই করতে পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। পশ্চিমবঙ্গ এখন পর্যটনের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছে, এবং ভবিষ্যতে এই গতি বজায় রাখতে পারলে রাজ্য আরও সমৃদ্ধ হবে।