২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে (West Bengal 2026 elections) সামনে রেখে বাংলার রাজনৈতিক (Bengal politics) আবহ ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। রাজ্যে ভোটের রাজনীতিতে মেরুকরণের প্রবণতা বাড়ছে, এবং সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা সেই মেরুকরণের আগুনে ঘি ঢেলেছে। বিজেপি হিন্দু ভোটকে পোক্ত করতে মরিয়া, আর তৃণমূল কংগ্রেস এরই মধ্যে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংককে ধরে রাখতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকির বৈঠক, পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর ফুরফুরা শরিফ সফর, এসবই স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সংখ্যালঘু ভোটকে এককাট্টা রাখার কৌশলে মনোযোগী তৃণমূল। অন্যদিকে, বিজেপি রাজ্যে হিন্দুত্বের রাজনীতিকে আরও প্রবল করতে চাইছে। তবে বাংলার ভোট পরিসংখ্যান বলছে, মেরুকরণ যত বাড়ে, ততই সংখ্যালঘু ভোট এককাট্টা হয়, যার সুবিধাভোগী হয় তৃণমূল।
সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাব ও পরিসংখ্যান
পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে অন্তত ১৪০টি আসনে সংখ্যালঘু ভোট ফ্যাক্টর বড় ভূমিকা পালন করে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এর মধ্যে ১২৫টি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল, মাত্র ১৪টি যায় বিজেপির ঝুলিতে, আর ভাঙড়ে জয়ী হয় আইএসএফ।
এই পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দেয়, সংখ্যালঘুদের বিপুল ভোট পায় তৃণমূল। এর মূল কারণ বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। বিজেপি যতই সংখ্যাগুরু ভোটের দিকে ঝোঁকে, সংখ্যালঘু ভোট তত বেশি করে তৃণমূলের দিকে সরে যায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৯৯ শতাংশেরও বেশি ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পায়, যেখানে সংখ্যাগুরুদের ভোট বিজেপি পেলেও তা সমানভাবে ভাগ হয়ে যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। ফলে, মেরুকরণের রাজনীতিতে বিজেপি যতই উগ্র হোক, তার চূড়ান্ত লাভবান হয় তৃণমূলই।
২০২১ ও ২০২৪-এর নির্বাচনী প্রবণতা
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন হোক বা ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন—প্রতি ক্ষেত্রেই বাংলায় এই মেরুকরণের চিত্র বারবার উঠে এসেছে। বিধানসভা ভোটে বিজেপি ৭৭টি আসন পেলেও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বেশিরভাগ আসনই তৃণমূলের দখলে ছিল। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেও স্পষ্ট হয়, যেখানে সংখ্যালঘুরা বেশি, সেখানেই তৃণমূলের দখল মজবুত।
বিজেপির মেরুকরণ কৌশল ও তার ফলাফল
বিজেপি বরাবরই হিন্দু ভোটকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছে। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীকে বড় আকারে উদযাপন, গেরুয়া শিবিরের নেতাদের একের পর এক সাম্প্রদায়িক মন্তব্য—এসবই বিজেপির কৌশলের অংশ। কিন্তু বাংলার বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলায় সংখ্যালঘুদের ভোট বিশাল সংখ্যায় একত্রিত হলে বিজেপির পক্ষে জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে যায়।
অন্যদিকে, তৃণমূল সংখ্যালঘুদের আস্থা ধরে রাখতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। মুসলিম ভোটকে নিজেদের ঘাঁটিতে পরিণত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প চালু করেছেন। যেমন, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ, সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ অনুদান। পাশাপাশি, ফুরফুরা শরিফের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোর প্রতি তৃণমূলের বিশেষ নজর রয়েছে।
তৃণমূলের সুবিধা ও ভবিষ্যতের রাজনীতি
বর্তমান পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের ভোট প্রায় পুরোপুরি তৃণমূলের দিকেই রয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপি সংখ্যাগুরু ভোটকে একত্রিত করার চেষ্টা করলেও তা পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। হিন্দু ভোট নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত, এবং তার একটি বড় অংশ এখনও তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছে।
এই কারণেই বাংলায় বিজেপি যতই মেরুকরণের রাজনীতি করুক, তার মূল লাভ হয় তৃণমূলের। আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটেও এই প্রবণতা বজায় থাকবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। মেরুকরণ যত বাড়বে, ততই সংখ্যালঘু ভোট আরও সংহত হবে, যার ফায়দা তুলবে তৃণমূল কংগ্রেস।
বাংলায় রাজনীতির চালচিত্র ক্রমশ বদলাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—মেরুকরণের রাজনীতি যত তীব্র হবে, ততই তৃণমূলের ভোটব্যাংক শক্তিশালী হবে। বিজেপি হিন্দু ভোটকে পুঁজি করতে চাইলেও, তা কার্যত তৃণমূলেরই সুবিধা এনে দিচ্ছে। ফলে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রধান শক্তি হবে সংখ্যালঘু ভোট, যা তাদের জয়ের রাস্তা আরও প্রশস্ত করতে পারে।